সেই ত্রয়ী: পিকে এবং বলরামের সঙ্গে চুনী। ফাইল চিত্র
সে বার সন্তোষ ট্রফি খেলতে গিয়েছি তিরুঅনন্তপুরমে। সালটা ১৯৫৬। আমি হায়দরাবাদের হয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। চুনী (গোস্বামী) বাংলার হয়ে। ওখানে যাওয়ার পর থেকেই শুনছিলাম চুনীর কথা। আমরা প্রায় সমবয়সি। সবাই বলছিল, ও নাকি দারুণ প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার। কলকাতার মোহনবাগানের হয়ে ভাল খেলছে। দুর্দান্ত ড্রিবল করে। অসাধারণ পাস দেয়। গোলের জায়গা করে নিতে পারে মুহূর্তে। এটা শোনার পর থেকেই ওকে দেখার ইচ্ছে ছিল। আর মনের মধ্যে বার বার একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, চুনীর মধ্যে কী এমন খেলা আছে, যা আমার নেই! যত দূর মনে পড়ছে, ও একটা ম্যাচই খেলেছিল এবং সেটা সেমিফাইনাল। বাংলা হেরে গিয়েছিল মুম্বইয়ের কাছে। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। বাংলা হারলেও চুনীর খেলা ভালই লেগেছিল। তবে আমি যে ওর চেয়ে খারাপ খেলি, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না মন থেকে। পরে বুঝেছিলাম, কম বয়সে এ-রকম হয়, সমবয়সিদের মধ্যে একটা দেখানোর জেদ তৈরি হয়। চুনীই হয়তো উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাকে, না হলে দেশের নানা জায়গার এত ক্লাব থেকে প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও কেন চলে এসেছিলাম কলকাতায় খেলতে! ওর সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। পিকের মতোই ছিল বন্ধুত্ব। দেশের হয়ে খেলার সময় আমরা চুনী-পিকে-বলরাম হয়ে যেতাম। তখন এক আত্মা, এক প্রাণ। কিন্তু ক্লাবের জার্সি পরলেই মনের মধ্যে একটা তাগিদ চলে আসত নিজের ক্লাবকে জেতানোর। যখন ডার্বি হত, তখন তো আর কথাই নেই। চুনীর মোহনবাগানকে হারানোর জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকতাম। শুধু কলকাতা লিগ নয়, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স, ডুরান্ড কাপ যেখানেই দেখা হত, তখন হারানোর চেষ্টা করতাম মোহনবাগানকে। আমি লাল-হলুদ জার্সিতে আর চুনী মোহনবাগান জার্সিতে— এই দ্বৈরথ দেখার জন্য সারা বাংলা উত্তাল হয়ে উঠত তখন। বলতে পারেন, এই লড়াইটা উপভোগ করব বলেই বার বার প্রস্তাব এলেও কখনও মোহনবাগানে যাইনি। ইস্টবেঙ্গলে থেকে গিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমাদের লড়াইটা ছিল নব্বই মিনিটেরই। তবে এটা স্বীকার করছি, চুনীকে আমি ফুটবলার হিসেবে সম্মানই করতাম।
আরও পড়ুন: ড্রিবলিংয়ে রাজা, ছিল টটেনহ্যাম থেকে ডাক
আমার জীবনে যত ফুটবলার দেখেছি, তার মধ্যে অন্যতম কমপ্লিট ফুটবলার ছিল চুনী। পায়ে দৃষ্টিনন্দন ড্রিবল ছিল, যা দেখে দর্শক উদ্বেল হয়ে যেত। ঠিক সময়ে পৌঁছে যেত গোলের সামনে। অসাধারণ পাসার ছিল। ভারতীয় দলের জার্সিতে এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক্সে খেলার সময় আমাকে গোলের কত যে পাস বাড়িয়েছে! দেখতে খুব সুন্দর ছিল। তাই ওকে সবাই ময়দানের উত্তমকুমার বলত। অনেকেই বলেন, দেখতে সুন্দর ছিল বলেই চুনীর জনপ্রিয়তা আমার বা পিকে-র চেয়ে একটু বেশি ছিল। আমি সেটা মানি না। ময়দানে তো কত সুন্দর দেখতে ফুটবলার এসেছে, কেউ কি চুনী হতে পেরেছে? আমার সঙ্গে চুনীর মিল ছিল, ও কখনও সবুজ-মেরুন জার্সি ছাড়েনি। টানা খেলে গিয়েছে মোহনবাগানে। আমিও কখনও ইস্টবেঙ্গল ছাড়িনি। এটা নিয়ে মাঝেমধ্যে জাতীয় শিবিরে আমরা কম হাসিঠাট্টা করিনি। আমি বলতাম, “যদি তোমার দলে নাম লেখাই, তা হলে তোমাকে হারাবে কে? ও একই কথাই বলত।” চুনীর কিংবদম্তি হওয়ার কারণ আমার মতে, ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেট এবং টেনিসও চুটিয়ে খেলা। ফলে উত্তমকুমারের মতোই একটা ইমেজ তৈরি করতে পেরেছিল।
আরও পড়ুন: শেষ মিনিটে ওঁর পাসেই এল জয়
চুনীর অধিনায়কত্বে এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছি। দেশের জার্সিতে দু’টো এশিয়ান গেমস ও রোম অলিম্পিক্সে খেলেছি। সতীর্থদের সঙ্গে দারুণ ব্যবহার করত। ক্লাব ফুটবলে লড়াইয়ের কথা মাথায় রাখত না। পিকে চলে গেল লকডাউনের ঠিক আগে, করোনা-আবহে। চুনীও গেল করোনা-আবহেই, তবে লকডাউনের মধ্যে। দুই প্রিয় বন্ধুকেই শেষ দিনে দেখা হল না। মনটা খারাপ। উত্তরপাড়ার যেখানে এখন থাকি, তার উল্টো দিকেই দক্ষিণেশ্বর। দেখা যায় বেলুড় মঠও। ছাদে উঠে সে দিকে তাকিয়ে থেকেছি চুনীর খবরটা শোনা পরে। বন্ধু তোমরা চলে গেলে আমাকে রেখে। এ-রকম তো কথা ছিল না।