জয় হো। রিওয় রুপোলি সিন্ধু। শুক্রবার। -রয়টার্স
রিও থেকে অলিম্পিক্স রুপো নিয়ে পিভি সিন্ধু ফিরছে। কিন্তু আমার কাছে সেটা সোনার পদকের চেয়েও দামি। বিশ্বের দু’নম্বর ইহানকে হারিয়ে পিভির সেমিফাইনালে ওঠার পরেই ঠিক করে ফেলেছিলাম দেশে ফিরলে ওকে একটা উপহার দেব। কিন্তু কী দেব ঠিক করতে পারছিলাম না। শুক্রবার ফাইনালে বিশ্বের এক নম্বর ক্যারোলিনা মারিনের কাছে পিভি শেষমেশ হারলেও ওর অনবদ্য লড়াই দেখার পর ওকে বলতে ইচ্ছে করছে, তুই মেয়ে আমাদের দেশের ব্যাডমিন্টনের হিরে! তোকে একটা হিরে উপহার দিতে পারলেই সবচেয়ে ভাল লাগত আমার। তবু ভাবিস না, দেশে ফিরলে একটা ভাল কিছুই পাবি তোর এই দিদির থেকে।
কী অদ্ভুত মনের জোর মেয়েটার! তিন গেমের হাড্ডাহাড্ডি ফাইনাল হেরে কোথায় পিভির নিজেরই কাঁদার কথা। একটুর জন্য অলিম্পিক্সে সোনা না পাওয়ার যন্ত্রণায়। তা নয়। উল্টে চ্যাম্পিয়ন মারিন যখন সোনা জেতার আবেগে কোর্টে কান্নায় ভেঙে পড়েছে, আমাদের পিভি-ই ওর পিঠে হাত রেখে স্বাভাবিক করল। জড়িয়ে ধরল। পিভি দেশকে রুপো দিয়ে রিওতে শুধু ভারতের তেরঙ্গা ওড়াল না আজ। অলিম্পিক্সের মতো মহান আসরে ভারতীয় সংস্কৃতির নিশানও ওড়াল। যার মূলকথা— স্পোর্টসম্যানশিপ।
নইলে প্রথম গেম হারার পর মারিনকে দেখলাম পিভির ছন্দ নষ্ট করতে দ্বিতীয় গেমের শুরু থেকেই নানা অছিলায় সময় চুরি করছে। এক বার শাটলকক পরীক্ষা করছে। এক বার কোর্ট ঝাঁট দিতে লোক ডাকছে। চেয়ার আম্পায়ারের সতর্কতাও গ্রাহ্য করছে না। কিন্তু পিভি এক বারও প্রতিবাদ করেনি। তার পরেও যে কেন আম্পায়ার মারিনের থেকে কোনও পেনাল্টি পয়েন্ট কাটলেন না, সেটা দেখে অবাক লাগল! স্প্যানিশ মেয়ে বিশ্বের এক নম্বর বলেই কি?
পিভি অবশ্য প্রতিপক্ষের র্যাঙ্কিং নিয়ে ভাবেনি। মারিনের কাছে কয়েক বার হারলেও কয়েক বার ওকে হারিয়েওছে। এ দিনও প্রথম গেমে সারাক্ষণ পিছিয়ে থেকে একেবারে বিজনেস এন্ডে টানা চারটে পয়েন্ট জিতে ফিনিশ করল। পিভির ওই অসাধারণ কামব্যাক দেখে মনে হয়েছিল, ও সোনাটাও দেবে। কিন্তু পরের দু’টো গেমে শুরুতেই পাঁচ-ছয় পয়েন্টে খুব তাড়াতাড়ি পিছিয়ে পড়ে এত বড় ফাইনালের চাপটা নিজের উপর নিয়ে ফেলল। আমার মতে এটাই পিভির হারের টার্নিং পয়েন্ট।
হারের আর একটা কারণও মনে হচ্ছে আমার। এত দিন জীবনের প্রথম অলিম্পিক্সে আন্ডারডগ হিসেবে সিন্ধু একদম খোলা মনে খেলেছে। আমার কিছু হারানোর নেই, চলো খেলাটা উপভোগ করি— এটাই ছিল পিভির মানসিকতা। মনে আছে, ওকে আমার কোচিংয়ে পাওয়ার প্রথম দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিশ্বের সেরা প্লেয়ারদের হারানোর জন্য তোর স্ট্র্যাটেজি কী? পিভির উত্তরটা এত বছর পরেও মনে আছে আমার। বলেছিল, ‘‘একদম খোলা মনে খেলব। আমার তো কিছু হারানোর নেই। তাই কোনও চাপও নেই। সব চাপ আমার বিপক্ষের উপর। কারণ সবার প্রত্যাশা ওকে নিয়েই। আর আমি যত খোলা মনে খেলব আমার খেলা তত ভাল হবে।’’
রিওতেও ফাইনালের আগে পর্যন্ত আমার মতে সেটাই চলছিল পিভির। কিন্তু ফাইনালে তা খুব সম্ভবত হয়নি। হাজার হোক অলিম্পিক্স ফাইনাল! প্লেয়ারের নিজেরই নিজের উপর একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। হবেই। আর সেই প্রত্যাশা তৈরি হতে পিভিও হয়তো অজান্তেই চাপে পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে প্রথম গেম জেতার পরে। দ্বিতীয় গেমে নামার সময় হয়তো ওর মনে হয়েছে, একটা, আর একটা গেম জিতলেই অলিম্পিক্স সোনা আমার গলায়! নইলে কেন শেষ দু’টো গেমেই গোড়াতেই অত বেশি পয়েন্টে পিছিয়ে পড়ল! অতটা পিছিয়ে পড়ার মতো তো পিভি খেলছিল না। ব্যাপারটা মনে হয় বেশিটাই মানসিক।
মারিনের অলরাউন্ড স্কিল বেশি। নেটের সামনে কব্জির অসাধারণ মোচড়ে ড্রিফ্ট ফ্লিক নেয়। খেলতে খেলতে অবস্থা বুঝে গেমপ্ল্যান পাল্টে ফেলে। শটে এত বেশি বৈচিত্র যে, একই শট পরপর দু’বার নেয় না। সব বোঝা গেল। আর এর সবই ফাইনালে দেখিয়েছে মারিন। কিন্তু তার জন্য পিভিও তৈরি ছিল। গোপী একেবারে ঠিক স্ট্র্যাটেজি কষেছিল ফাইনালে। জানা কথা ছিল, লম্বা বলে পিভিকে ব্যাকহ্যান্ডে বেশি খেলাবে মারিন। কারণ ব্যাডমিন্টনে খুব লম্বা প্লেয়ারের পক্ষে ব্যাকহ্যান্ডে জোরালো শট নেওয়া কঠিন। কিন্তু সেটাও পিভি এ দিন কয়েক বার কাটিয়ে উঠেছিল। প্রথম গেমে ওর প্রায় থার্ড কোর্ট থেকে প্রচণ্ড জোরে ব্যাকহ্যান্ডে নেওয়া গেম পয়েন্ট জেতার শটটা তো কোনও দিনও ভুলব না।
তবু শেষরক্ষা হল না। ওই যে বললাম, পিভি আজই ভুলে গিয়েছিল ও আন্ডারডগ। ফলে খেলাটাকে ওর আর উপভোগ করা হল না। আর তাতে রিওতে ওর প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আগ্রাসন আচমকা চাপের অদৃশ্য চাদরে ঢাকা পড়ল!