বিরাট পতন। কোহালির ক্যাচ ধরে রঞ্চির উল্লাস। ছবি: রয়টার্স
অমর কারলেকরকে মনে আছে?
রাত বারোটার জামথা। গোটা মাঠে ব্রডকাস্টারদের দু’এক জন ছাড়া কেউ পড়ে নেই। আর তিনি অমর কারলেকর, নাগপুর পিচ কিউরেটর, ফোনে তীব্র চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। “ভেবেছেনটা কী আপনারা? সাংবাদিকরা যা খুশি তাই বলবে? এটা খারাপ উইকেট? আমার কাছে এটা ভাল পিচ! কোনও টিম যদি ৭৯ অলআউট হয়ে যায়, তার ব্যাটসম্যানরা যদি না পারে সেটা আমার দোষ?” রীতিমতো হিংস্র শোনাচ্ছে তাঁর গলা। জিজ্ঞেস করা হল, টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দশ ওভারের মধ্যে বল দেড় হাত করে ঘোরার অপরাধ? সেটা কিউরেটরের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? যা নিয়ে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব বলে যাচ্ছে?
শুনে চিৎকার আরও তীব্র হল। আনন্দবাজারকে বললেন, “কে বলছে? কী বলছে? শুনুন কে কী বলছে, আমার জানার কোনও ইচ্ছে নেই। আর মিডিয়াকে জবাবদিহি করাটাও আমার কাজ নয়! আপনাদের যা মনে হচ্ছে লিখুন। লোকে যা বলতে চাইছে বলুক। আমার কিছু যায় আসে না!”
নাগপুর রাতের কলঙ্কিত নায়ক। যাঁর গলার তীব্রতা শুনলে বোঝা যাবে না ভেতরে ভেতরে আদৌ কোনও অপরাধবোধ কাজ করছে বলে। অথচ এ দিন তিনি এমন এক কাজ করছেন, প্রস্তুত করেছেন এমন এক লজ্জার বাইশ গজ যা শুধু মহেন্দ্র সিংহ ধোনির টিমের কাপ-অভিযানের আকাশে আচমকা কালো মেঘ হাজির করে দেয়নি। গোটা ক্রিকেটবিশ্বের কাছে নাগপুরের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। ইনি এমন এক টি-টোয়েন্টি পিচ তৈরি করেছেন যেখানে একশো আশি দূরের ব্যাপার, ১২০ তুলতে গেলে কালঘাম বেরিয়ে যায়। ঘরের টিম ঘরের মাঠে মাত্র ৮০ তুলতে না তুলতে শেষ হয়ে যায়। আর এ হেন নাগপুর কিউরেটরকে মনে রাখার একটাই কারণ। তা হল, এ জিনিস তাঁর জমানায় নতুন নয়। সমালোচনাও না। নভেম্বরের শীতে তাঁর তৈরি ‘স্পোর্টিং পিচে’ মাত্র সাড়ে তিন দিনে একটা টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছিল। গোটা বিশ্বের তুলোধোনার পাল্লায় তিনি সে দিনও পড়েছিলেন, থেকেও গিয়েছিলেন একই রকম নির্বিকার। নভেম্বর পেরিয়ে এখন মার্চ। শীত শেষ হয়ে অসহ্য দাবদাহ। কিন্তু তাঁর নিজ-চরিত্রের মতো পিচ-চরিত্রেও কোনও পরিবর্তন নেই।
সেই একই রকম খোঁয়াড়!
চোখের সামনে বিপর্যয় ঘটতে দেখেও কোনও কোনও নাগপুর কর্তা রাতের দিকে বলার চেষ্টা করছিলেন যে, পিচ নিয়ে এত কিছু মিডিয়াই বলছে। কোথায়, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো সাংবাদিক সম্মেলনে এসে পিচকে দোষারোপ করলেন না। উল্টে ব্যাটিংকে একহাত নিয়ে গেলেন। ঠিকই। আকস্মিক হারে শোকস্তব্ধ ভারত অধিনায়ককে পিচ নিয়ে নয়, ব্যাটিং নিয়েই বলতে শোনা গিয়েছে। তিনি বলেছেন যে, “একটা পার্টনারশিপ হল না। ওরা যত না ভাল বল করেছে, তার চেয়ে খারাপ আমরা ব্যাট করেছি। বাজে শট খেলে অনেকে আউট হয়ে গিয়েছে।” মুশকিল হল, ধোনিকে আজ কিছু তো একটা বলতে হত। যে পিচ ছিল তাঁর এত দিনের বিপক্ষ-বধের ব্রহ্মাস্ত্র, যে পিচে স্পিনের মাইন পুঁতে বিদেশি বিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনি জিততেন একের পর এক সিরিজ, আজ সেটাই ঘুরে তাঁর দিকে ছুটে এল। ক্রিকেটমহলের একটা অংশ বলছে, এ তো ভারতেরই ফরমাইশ করা ডিজাইনার পিচ। যেখানে পুরো কুড়িটা ওভারও খেলতে পারল না টিম ইন্ডিয়া। যেখানে স্পিনাররা মিলে নিল ভারতের ন’টা উইকেট! এর পর ধোনি কোন মুখে উইকেট নিয়ে বলবেন?
এবং বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপট ও নমুনা দু’টোই ভারতবাসীর পক্ষে অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক। ভাবা যায়, এটা আইসিসি চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহরের শহর। এটা তাঁর ঘরের মাঠের বাইশ গজ। যা গত নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টে কলঙ্ক উপহারের জন্য ইতিমধ্যে আইসিসির কড়া ধাতানি খেয়ে রয়েছে। ন্যূনতম চেতনা বোধের উদয় দূরস্থান, মঙ্গলবার সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে তা মিনিটে-মিনিটে লজ্জার দিকে ঠেলে দিয়েছে একই সঙ্গে ভারত ও ভারতীয় টিমকে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট আর টিভি দুনিয়া আবার নামিয়ে দিয়েছে গোটা ক্রিকেটপৃথিবীকে। মইন খান বলেছেন, ‘এ সব পিচকে ব্যান করে দেওয়া উচিত।’ মাইকেল ভন লিখেছেন, ‘বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ এ সব আন্ডারপ্রিপেয়ার্ড পিচে হওয়া উচিত নয়।’ দেশের আমজনতা? নাগপুরের মতো তাঁরাও ঠকে ক্ষিপ্ত। তাঁরাও ক্ষোভ প্রকাশে নেমে পড়েছে মাঠ থেকে মাঠের বাইরে। ফেসবুক-টুইটারে কাউকে কাউকে লিখতে দেখা গেল, কলকাতায় এর পর পাকিস্তানের চেয়ে ভারতীয় টিমের বোধহয় বেশি নিরাপত্তার দরকার পড়বে! কেউ আবার দাবি তুলছেন, গোটা ভারতীয় টিমকে হিমেশ রেশমিয়ার সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া হোক! ওটাই এই হারের শাস্তি। জামথা আবার এত সরব ভঙ্গিমায় নয়, নীরব প্রতিবাদ করে গেল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ডিজে-র ব্যবস্থা আছে আইপিএলের মতো। জামথা মাঠের ডিজে-কে এক সময় দেখা গেল, গান-বাজনা থামিয়ে গ্যালারিকে উদাত্ত সমর্থনের জন্য আবেদন করতে। উত্তরে একটা টুঁ শব্দও এল না। লোকে কাকে দেখে নাচবে? কার উদ্দেশ্যে গলা ছেড়ে চিৎকার করবে? স্কোরবোর্ড তো দেখাচ্ছে ভারত ৭৩-৮!
আউটের ধরনও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। রোহিত শর্মা দ্রুত একটা উইকেট পড়তে দেখেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সুরেশ রায়না, যিনি কি না স্পিন খেলার ব্যাপারে টিমে অগ্রগণ্যদের এক, তিনি পর্যন্ত চকিত লাফিয়ে ওঠা স্যান্টনারের একটা ডেলিভারি ম্যানেজ করতে পারলেন না। যুবরাজ সিংহ বোলারের হাতেই লোপ্পা তুলে দায়িত্ব মেটালেন। বাঁচাতে পারতেন দু’জন। বিরাট কোহালি এবং ধোনি স্বয়ং। কোহালি রোজ বিপদের দিনে এক লড়ে জেতাবেন, আশা করা অন্যায়। আর ধোনি তিনি কোনও পার্টনারই পাননি। নন স্ট্রাইকার এন্ডে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে দেখতে হচ্ছে, কী ভাবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে কাপ-ফেভারিটের গর্ব।
ভয় এখানেই। ভারতের আজ থেকে বিশ্বকাপে যে ক’টা ম্যাচ বাকি আছে, সব ক’টা বাঁচা-মরার হয়ে গেল। ধোনি বললেন, “আমার কাছে এই চাপ নেওয়া কোনও নতুন ব্যাপার নয়। এমন একটা ম্যাচ আমি মনে করতে পারি না যেখানে চাপহীন ভাবে আমাকে নামতে হয়েছে। আমি বলব, এটা গুড ওয়েক আপ কল। সমর্থকদেরও বলছি, টুর্নামেন্ট নিয়ে চিন্তায় পড়বেন না।”
না পড়লেই ভাল। বোধোদয় হলেই ভাল। টুর্নামেন্টের গোড়াতেই স্বপ্নের তাজমহলের শহিদ-মিনারে রূপান্তর কোন ভারতবাসীরই বা ভাল লাগবে?
সংক্ষিপ্ত স্কোর
নিউজিল্যান্ড ১২৬-৭ (অ্যান্ডারসন ৩৪, রঞ্চি ২১, বুমরাহ ১-১৫)
ভারত ৭৯ (ধোনি ৩০, কোহালি ২৩, স্যান্টনার ৪-১১, সোধি ৩-১৮)