হবসন স্ট্রিটে ধোনিদের টিম হোটেল।
কালো জ্যাকেট পরে মুশকো চেহারার যে লোকটা ঠিক হেরিটেজ হোটেলে ঢোকার মুখে গেট ব্লক করে দাঁড়িয়ে, বিদেশের কোনও চারতারা হোটেলে এই ভাবে কেউ দাঁড়ায় না। তার চাউনি, প্রতিটি আগন্তুককে মাপার ধরনেই বোঝা যাচ্ছে এ হোটেলকর্মী নয়। হতে পারে না। প্রতিটি কাস্টমার সম্পর্কে এত সন্দিগ্ধ হলে যে কোনও হোটেল উঠে যাবে।
হেরিটেজ হোটেল, হবসন স্ট্রিট। বিশ্বকাপে পাঁচে পাঁচ পাওয়া ভারতীয়দের আপাতত এটাই ঠিকানা।
পাঁচে পাঁচ এই জন্য উল্লেখ করলাম যে, একটা টিম খারাপ খেললে, তার সম্পর্কে নানা গুজব ছড়াতে শুরু করলে দুমদাম করে টিম সেন্সরশিপ চালু করে থাকে। তখন যেন তেন প্রকারেণ তার উদ্দেশ্য থাকে মিডিয়ার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে দিয়ে তাকে যথাসম্ভব উপোসি করে রাখা। অথচ একটা টিম ক্রমাগত জিতছে এমন অবস্থায় স্বদেশীয় সাংবাদিকদের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে, কেউ যেন হোটেলে ঢুকতে না পারে। এই ঘটনা বিশ্ব ক্রিকেটে অভূতপূর্ব। এমনকী টিভি চ্যানেলের লোকজনের ওপরও নতুন বিধি। যেন তাঁরা রাস্তার উল্টো দিক থেকেও ছবি তুলতে না পারেন। হবসন স্ট্রিটের ঠিক উল্টো ফুটপাথ রীতিমতো পাবলিক প্লেসই নয়, ভরা গিজগিজে জায়গা। কিন্তু সেখানেও মিডিয়া-বসতি অ্যালাউ করা হচ্ছে না।
দুপুরে হেরিটেজ হোটেলের কফিশপে গিয়ে নতুন নিষেধাজ্ঞা প্রথম টের পাওয়া গেল। একটু দূরে চশমা পরা কোহলি হনহনিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। অশ্বিন লিফট্ থেকে নামলেন। চোখাচোখি হতে না হতেই মাথা নামিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এঁদের এখন মিডিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি করারও বোধহয় অনুমতি নেই। তখনকার মতো অবাক লাগছিল তাঁরা সবাই হোটেলে অথচ মিডিয়ার কেউ নেই কেন? দ্রুত দেখা গেল ক্রমাগত নিরাপত্তারক্ষীরা এসে এসে খোঁজ নিচ্ছে আপনি কে ভাই? এখানে কী চাই? হাতে কফির কাপ দেখেও এদের বিরাম নেই। রাতে সর্বভারতীয় যাবতীয় চ্যানেলের প্রতিনিধিরা ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছিলেন, তাঁদের টিম হোটেলের ভেতরে অন্য দিনকার মতো ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এক ক্যামেরাম্যান উত্তেজিত ভাবে বললেন, “উল্টো দিকের ফুটপাথ থেকেও সিকিওরিটি ছবি তুলতে দিচ্ছে না। বলছে, মিডিয়া আর কুকুর একেবারে দূরে।”
সমর্থকেরাও কাছে ঘেঁষতে পারছেন না। এমনিতে অকল্যান্ড ভারতীয়তে ভর্তি। ভারতীয় রেস্তোরাঁতেও ভর্তি। গুগল ম্যাপে অকল্যান্ডে ভারতীয় রেস্তোরাঁ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে ম্যাপটা লালে লাল হয়ে রয়েছে। আর সেই রেস্তোরাঁর কাস্টমাররা মানে নব্য ভারতীয়রা বেশির ভাগই এদেশে এসেছেন দু’হাজার সালের পর। বয়স খুব বেশি নয়। দৌড়ঝাঁপ করতে কোনও অসুবিধে নেই। আর স্পোর্টসে প্রচণ্ড উত্সাহ। বাঙালি মুখের মধ্যে তো এমন একাধিক সাক্ষাত্ পাওয়া গেল যাঁরা ওয়েবে দৈনিক আনন্দবাজার আপলোড হওয়ামাত্র স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে এগারোটা নাগাদ খেলার পাতা নিয়ে বসে যান। কলকাতা তখনও ঘুমন্ত, কাগজই পায়নি। আর এঁরা তখন গোগ্রাসে গেলেন ইস্টবেঙ্গল থেকে ধোনি, সব কিছু। অর্ডারে তার পর আসে সারদা। এই শ্রেণিও ভারতীয় ক্রিকেট টিমের নতুন স্টান্সে বিস্ফারিত।
হেরিটেজ এমনিতে মোটেও অকল্যান্ডের সেরা তিন হোটেলের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু জায়গাটা সিবিডি-র ভেতর। আর খুব জমজমাট। এক হাতের মধ্যে নামী ভারতীয় রেস্তোরাঁ। শপিং মল। তাই ম্যাসাজ পার্লার। দু’তিনটে ব্লক এগোলে ডান দিকে থিয়েটার। আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিশ্ববিখ্যাত অকল্যান্ড স্কাই টাওয়ার্স। হেরিটেজের লবি থেকে বিরাট কোহলির একটা কড়া অনড্রাইভ এসে স্কাই টাওয়ার্সে ধাক্কা খাবে এত কাছে! ভারতীয় দল নিউজিল্যান্ড সফরে এলে সাধারণত স্কাই টাওয়ার্স ঘুরে যায়। সচিনের শেষ অকল্যান্ড সফরেই তো সেই অ্যাডভেঞ্চারের ছবি রয়েছে যে তিনি বিপজ্জনক স্কাই ওয়াকে স্কাই টাওয়ার্সের ছাদের বাইরে ঝুলছেন। শক্ত করে দড়িতে টেনে ধরা। তাঁর নীচে অকল্যান্ড শহর।
এ বারও ফটোগ্রাফার এবং চ্যানেলের লোকজন ওঁত পেতে ছিলেন স্কাই ওয়াকের ছবির জন্য। কিন্তু কাউকে দেখা গেল কোথায়? সুরেশ রায়নাকে দেখলাম হাঁটতে হাঁটতে উল্টো দিক থেকে আসছেন। টুপিটা মুখের ওপর আদ্ধেক ঢাকা। যাতে চট করে কেউ চিনতে না পারে। দেখে খারাপই লাগল! আগে ক্রিকেটাররা বলতেন, ভারতে তাঁদের কোনও প্রাইভেসি নেই। একমাত্র বিদেশে সিরিজ হলে তাঁরা রিল্যাক্সড থাকতে পারতেন। এখন তো শুধু মিডিয়াতে রক্ষা নেই। নানা ট্রাফিক সিগন্যালে ভারতীয় সমর্থক ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে। কাউকে দেখল কী মোবাইলে ক্লিক করে দ্রুত ফেসবুকে দিয়ে দিল বাকি পৃথিবীর জন্য! রায়নাকেও তো চিত্কার করল, ও রায়না দাঁড়াও, দাঁড়াও। রায়না পিছনে তাকালেন না পর্যন্ত। অকল্যান্ডে আসলে গত টেস্ট সিরিজের সময় পার্নেল নামক একটা স্থানীয় জায়গায় ঠিক এই ভাবে অনুষ্কা-বিরাটের ছবি পেয়ে যান এক ফ্যান। সেখান থেকে ছবি ছড়িয়ে যায় গোটা বিশ্ব। টিম ইন্ডিয়ার জেনারেশন ওয়াইয়ের তাই দেশ থেকে এত হাজার মাইল দূরে এসেও নিষ্কৃতি নেই। আর এঁদের ব্যক্তিগত অধিকার যত সঙ্কুচিত হচ্ছে, ততই চক্ষুশূল হয়ে পড়ছে মিডিয়া।
এই হ্যামিল্টন ম্যাচ নিয়ে। অকল্যান্ডের পুরনো ইন্ডিয়া ম্যাচ নিয়েও কত গল্প আছে। সচিন-কাম্বলির সেখানে তীব্র খুনসুটির কথা আজও ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আলোচিত হয়। বলা হয়, সচিন বিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে পাক অফস্পিনারকে মারতে পারেননি বলে কাম্বলি তাঁর পিছনে লেগেছিলেন। ক’টা ম্যাচ পরেই হ্যামিল্টনে যখন ধূর্ত জন ট্রাইকসের অফস্পিনে নাজেহাল কাম্বলি, দলবল নিয়ে সচিন তাঁকে টিটকিরি দেওয়া শুরু করেন। এই যে বিশাল ব্যাটসম্যান, ঠিক করে মার অফস্পিনারকে।
কিন্তু এই মুহূর্তে গল্প বলবে কে? শুনবেই বা কে? রবি শাস্ত্রী সে দিন বলছিলেন, “ভরত অরুণকে মিডিয়ার যথেষ্ট আলোকিত করা উচিত। বোলিং কোচ হিসেবে গত এক মাসে দারুণ কাজ করার জন্য।”
কিন্তু আলোটা ফেলা হবে কী করে? ভরত অরুণকে সামনাসামনি পেলে তবে তো! সফরে দু’চার জন সাংবাদিকের সঙ্গেও যদি তাঁর হাই-হ্যালো হয়ে থাকে, সেটা চমকপ্রদ হবে।
রাতের দিকে বৃষ্টি নামল অকল্যান্ডে। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী ইডেন পার্ক ও শহরজুড়ে ওটা নামার কথা শনিবার। দু’দিন আগেই কি শুরু হয়ে গেল? ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গোল হয়ে বসা চ্যানেলওয়ালারা এই সব প্র্যাকটিকাল আলোচনাতেই নেই।
তাঁরা তখনও উত্তেজিত— কুকুর আর মিডিয়া অ্যালাউড নয়। এত বড় কথা বলার সাহস কী করে হতে পারে?
অস্ট্রেলিয়ায় ডালমিয়া
বিশ্বকাপে ভারতের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দেখতে সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ায় উড়ে যাবেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া। ১৬-১৭ তারিখ হয়তো তিনি অস্ট্রেলিয়ায় রওনা হবেন বলে সিএবি সূত্রের খবর। সে জন্য সিএবি তাঁর যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছিল, তা পিছিয়ে যেতে পারে। ডালমিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তা হতে পারে বলে জানিয়েছে সিএবি।