সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে মুম্বইয়ের মালিক রণবীর কপূর।
নিলামে কেনার পর মঞ্চে গিয়ে পুণের জার্সিটা তাঁর হাতে তুলে দিলেন হৃতিক রোশন। তারপর ইউজিনসন লিংডোকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন কেমন লাগছিল আপনার?
দেশের সেরা প্রতিশ্রুতিমান মিডিওর উচ্ছ্বসিত গলা থেকে জবাব এল, ‘‘মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি বা ফ্রিকিক থেকে অসাধারণ একটা গোল করেছি।’’
রণবীর কপূরের পাশে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করার সময় সুনীল ছেত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হল, প্রত্যাশার চেয়ে কি কিছুটা কম দামে বিক্রি হলেন মুম্বইতে। ভারতের সর্বকালের সেরা গোলদাতার মুখের আলোটা যেন একটু কমল। কিন্তু তিনি সুনীল, ভাইচুং ভুটিয়ার পর দেশজ ফুটবলের সেরা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর। মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজেকে। ‘‘আমি টাকার জন্য খেলতে আসিনি। আনেলকার মতো ফুটবলারের সঙ্গে খেলব এটাই তো বিশাল ব্যাপার। এটাই তো চাইছিলাম।’’ সাবলীল হয়ে বলে দেন ভারত অধিনায়ক।
দেশ বিদেশে সত্তরটির বেশি নিলাম পরিচালনা করে আসা ইংল্যান্ডের চার্লি রসও হাতুড়ি ঠুকে সুনীলের নাম ঘোষণা করার আগে মজা করলেন, ‘‘ভারত অধিনায়কের জন্য মাত্র দু’জন ক্রেতা। আর কাউকে পাচ্ছি না।’’
আইএসএলের নিলামের পর শুক্রবার দুপুরে ক্রোড়পতি হয়ে গেলেন সুনীল ছেত্রী এবং ইউজিনসন লিংডো। কিন্তু যে ভাবে সেটা হল তা বিস্মিত করে দিল পাঁচ তারা হোটেলের বিশাল বলরুমকে।
কেন? কারণ দু’টো।
এক) সুনীলের জন্য লড়ল শুধু দু’টো ক্লাব। দিল্লি আর মুম্বই। আর লিংডোকে পাওয়ার জন্য কলকাতা-সহ ছটি ক্লাব।
দুই) লিংডো তাঁর বেস প্রাইসের (সাড়ে সাতাশ লাখ)প্রায় চার গুণ দামে বিক্রি (এক কোটি পাঁচ লাখ) হলেন। আর সুনীল বেস প্রাইস (৮০ লাখ) থেকে পেলেন সামান্য বেশি (এক কোটি কুড়ি লাখ)।
কোটিপতি হওয়ার মুখে আটকে গেলেন রিনো অ্যান্টো আর থই সিংহ। সাইড ব্যাক রিনোকে কলকাতা কিনল ৯০ লাখে। আর থোই সিংহ গেলেন মুম্বইতে ৮৬ লাখে। রবিন সিংহ দিল্লিতে গেলেন মাত্র ৫১ লাখে।
দেশ এবং ক্লাবের হয়ে সুনীলের যা সাফল্য তাঁর একশো মাইলের মধ্যেও নেই লিংডো, রিনো বা থোই। দর্শক হয়ে এসে জাতীয় কোচ স্টিভন কনস্ট্যানটাইনকে তাই দেখতে হল তাঁর দলের দুই স্ট্রাইকারের মশলা লিগের বাজার!
আইএসএলের নিলামে এ দিন দুপুরে অবশ্য চমকের অভাব ছিল না।
বিশ্বফুটবলের কিংবদন্তী তিন ফুটবলার রবের্তো কার্লোস, জিকো এবং মাতেরাজ্জি ফুটবলার বাছলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসে। তা-ও আবার ফিফা র্যাঙ্কিং-এর ১৫৪ নম্বরে নেমে যাওয়া দেশে এসে। দেখে যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।
বলিউড়ের চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সব কাজ ছেড়ে বোর্ড তুলে তুলে দাম-দর হাঁকলেন জন আব্রাহাম, হৃতিক রোশন, রণবীর কপূররা। এবং বেশ আগ্রহ নিয়েই। মঞ্চে উঠে কোন ফুটবলারকে কেন নেওয়া হল তারও ব্যাখা দিতে দেখা গেল তিন ফুটবল প্রেমী নায়ককে।
মনে হচ্ছিল ভিটামিন ‘এম’-এ কি না হয়!
সবথেকে বড় চমক দিলেন নামী ফুটবল ধারাভাষ্যকার এ দিনের ঘোষক জন ডাইক্স। ‘‘বিশ্বের বহু নিলাম দেখেছি। কোথাও শুনিনি নিলামের সব পণ্য বিক্রি হয়েছে। বাজারে ফেললে সবই তা হলে বিক্রি হয়।’’ নাটকীয় ভাবে বলছিলেন তিনি। তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন টুর্নামেন্টের মালিক নীতা অম্বানী।
নিলাম এবং ড্রাফট দু’টোই ছিল এ দিন। কিন্ত সব উত্তেজনা শুষে নিল প্রথমটাতেই। পাশের ঘরে সুনীল, লিংডো-সহ নিলামের নয় (রবিন ছিলেন না) ফুটবলারকে বসিয়ে রেখে যখন তাদের প্রকাশ্যে বেচা-কেনা চলছিল, তখন তাদের দেখে মনে হচ্ছিল সবাই প্রচণ্ড টেনশনে। ‘‘ভেবেছিলাম সত্তর লাখের বেশি দাম উঠবে না। কিন্ত কোটিতে পৌঁছোনোর পর বুকটা ধড়ফড় করছিল’’ বুকে হাত ঠেকিয়ে বলছিলেন লিংডো। আর তাঁকে চেন্নাইয়ান ছাড়া কেউ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে টেনশনে হাতের প্রায় সব নখই খেয়ে ফেলেছেন কিপার করণজিৎ সিংহ। আরাতা ইজুমি আর আনাসকে দেখা গেল টেনশনে চোখ বুজছেন বারবার। বেস প্রাইসের চেয়ে দরই যে উঠছে না।
এত আলো। এত বৈচিত্র। কোটি কোটি টাকার হাত বদল। পাঁচ তারা হোটেলের এলাহি আয়োজন। কিন্তু তার মধ্যেই অন্তত বাহাত্তর জন ফুটবলারের জীবনে নামল অন্ধকার। ড্রাফটে যে তাদের কেউ কিনলই না।
সুনীল-লিংডোরা যখন কোটির আলোয় গা ভাসাচ্ছেন তখন শিল্টন পাল, মহম্মদ রফিক, বিভান ডি’মেলোরা তো ক্লাবই পেলেন না।
নাটকীয় ঘটনার দিনে এটাই সম্ভবত সেরা অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স!
গ্যালারিতে তারার মেলায়