স্মরণ: চুনী গোস্বামীর মৃত্যুদিবসে ক্লাবের লনে শ্রদ্ধার্ঘ্য। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
চুনী গোস্বামীর প্রয়াণের এক বছর পরেও যন্ত্রণাটা ভুলতে পারছি না। চুনীদা যে ছিলেন আমার ঈশ্বর।
আমার প্রথম ঈশ্বর দর্শন হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ৮ মে। সম্ভবত কলকাতা লিগে সেই মরসুমে মোহনবাগানের প্রথম ম্যাচ ছিল হাওড়া ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। শ্যামনগর থেকে খেলা দেখতে মোহনবাগান মাঠে গিয়েছিলাম। সে দিন দেখেছিলাম, এক জন ফুটবলারের জনপ্রিয়তা কোথায় পৌঁছতে পারে। মোহনবাগান মাঠের গ্যালারি ভরে উঠত মূলত চুনীদার আকর্ষণেই। উত্তম কুমার ছিলেন তাঁর অন্যতম ভক্ত। কী অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ ছিল বলের উপরে। মনে হত যেন, সবুজ ঘাসে কোনও শিল্পী তুলি দিয়ে আলপনা আঁকছেন। চুনীদা কখনওই গা-জোয়ারি খেলতেন না বলে আরও দৃষ্টিনন্দন লাগত ওঁর ফুটবল। দু’পায়েই কাটাতে পারতেন। শরীর ব্যবহার করতেন শুধু মাত্র বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের বোকা বানানোর জন্য। তাই চুনীদাকে কখনও মেরে আটকাতে পারতেন না বিপক্ষের ফুটবলারেরা। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ওঁর খেলা। মুগ্ধতার সেই রেশ সারাজীবনই থেকে যাবে।
চুনীদার জন্যই আমি ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। সেই ঘটনা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমার বয়স তখন ২১ কী ২২। শ্যামনগরে থাকতাম। খেলার সূত্রেই চাকরি পেয়েছিলাম বিএনআর-এ। সে বার ইস্টবেঙ্গল আমাকে সই করার প্রস্তাব দেয়। আমিও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। সে দিন শনিবার ছিল। শ্যামনগরে বেড়ার ঘরে থাকতাম। তখন সকাল প্রায় এগারোটা। হঠাৎ আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লেন চুনীদা। সঙ্গী ছিলেন গজুদা। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বাবা তো চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন। আমারও এক অবস্থা। চুনীদা বাবাকে বললেন, মোহনবাগানে এ বার সুব্রতকে চাই। আমি কিছু বলার আগেই বাবার নির্দেশ, ‘‘চুনীবাবু যখন এসেছেন, তখন তোমার কথা বলার কোনও প্রশ্নই নেই। উনি তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, সেখানেই যাবে।’’ কিছু ক্ষণের মধ্যে চুনীদার গাড়িতে করেই রওনা হয়েছিলাম কলকাতার উদ্দেশে। সই করার পরে চুনীদা বলেছিলেন, “কথা দে, তুই কখনও মোহনবাগান ছাড়বি না।” আমি গর্বিত, চুনীদাকে দেওয়া কথা রাখতে পেরে। মাঠে ও মাঠের বাইরে চুনীদা ছিলেন প্রকৃত নেতা। ওঁর মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ আমি দেখিনি। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস- তিনটি খেলাতেই অসামান্য দক্ষতা ছিল। আর ছিল অন্যদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। ১৯৭৭ সালে কলকাতা লিগের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে আমরা তখন মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কোচ থাকা সত্ত্বেও আইএফএ শিল্ড ফাইনালের আগে চুনীদাকে মাঠে নিয়ে এলেন ধীরেন দে। উনি আমাদের কয়েক জনকে ডেকে বলেছিলেন, “কী হচ্ছে এ সব? আমি আর হার দেখতে চাই না। এ বার তোমাদের জিততেই হবে।” আমরা শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আরও একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে বছরই পেলের কসমস ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ। মোহনবাগানের ম্যানেজার হয়েছিলেন চুনীদা। ম্যাচের আগের দিন অনুশীলনে এসে বলেছিলেন, “বিপক্ষে ফুটবল সম্রাট রয়েছেন তো কী হয়েছে? পেলে তাঁর খেলা খেলবেন। তোমরা নিজেদের খেলা খেলো। পেলেকে ভয় পেও না। মাথা কখনও নিচু করবে না।” ম্যাচ ২-২ হওয়ায় আনন্দে চোখ ভিজে গিয়েছিল চুনীদার।
১৯৮৫ সালে চুনীদা ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব। লিগে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারের পরে চুনীদা আমাদের রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, “দেখি তোমরা ঘুরে দাঁড়াতে পার কি না।” সে বছর আমরা ডুরান্ড, রোভার্স কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আনন্দে চুনীদা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। বলেছিলেন, “তোমরা ফুটবলার নও, বাঘ।”
ভারতীয় ফুটবলের এই কিংবদন্তির সঙ্গে খেলার সৌভাগ্য আমার হয়নি। মনে আছে, খেলা ছেড়ে দিলেও চুনীদা শারীরচর্চা করতে মোহনবাগান মাঠে চলে আসতেন। আমরা তখন অনুশীলন করলে কী হবে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ওঁর দিকে। মাঝে মধ্যে বলতেন, “আজ তোমাদের সঙ্গে আমিও খেলব।” আমাদের জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি ছিল ওঁর মতো ফুটবলারের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাওয়া। দারুণ অনুপ্রাণিতও হতাম। চুনীদার পুরো জীবনটাই ছিল মোহনবাগানকেন্দ্রীক। সব সময় ভাবতেন ক্লাবের উন্নতি ও সাফল্যের কথা। মোহনবাগানের প্রতি এতটাই ভালবাসা ছিল যে ফুটবলারদের সকলের সঙ্গে সে ভাবে কথা বলতে না। নির্দিষ্ট কিছু ফুটবলারের সঙ্গেই কথা বলতেন। যাদের মানসিকতা মোহনবাগানের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলত! অনেকেই অবশ্য এই ব্যাপারটা ভাল ভাবে নিতেন না। যদিও চুনীদার তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। নিজের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতেন। আমরা অনেকেই ওঁকে নকল করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারতাম না। চুনীদা এক জনই। মাঠের ভিতরে। মাঠের বাইরে। আমাকে বলতেন, “যে আসবে, তার সঙ্গেই কথা বলতে হবে না কি? তুমিও সকলের সঙ্গে কথা বলবে না। আত্মসম্মান কখনও বিসর্জন দিও না সুব্রত।”
চুনীদার সেই পরামর্শ আমার কাছে আজও মন্ত্রের মতো।