টেনিস সার্কিটে খানিকটা ঘোরাঘুরির সুবাদে দেখেছি স্ট্যানিসলাস ওয়ারিঙ্কা-র ওখানে ডাকনাম ‘স্ট্যান দ্য ম্যান’। সোমবার থেকে ট্যুরে ওর নতুন ডাকনাম ‘স্ট্যান দ্য বিগ ম্যাচ ম্যান’ হলে অবাক হব না!
অন্তত এ দিন চার ঘণ্টার মারকাটারি ফাইনালে ভারতীয় সময় ভোরবেলায় ওয়ারিঙ্কা তর্কাতীত ভাবে সাম্প্রতিক টেনিসে বিশ্বসেরা জকোভিচকে যে ভাবে ৬-৭ (১-৭), ৬-৪, ৭-৫, ৬-৩ হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন চ্যাম্পিয়ন হল, তার পর ওকেই সেরা ‘বিগ ম্যাচ ম্যান’ বলতে দ্বিমত থাকার কথা নয়। তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলে তিনটেই চ্যাম্পিয়ন। তার ভেতর দু’টোয় ফাইনালে জকোভিচকে হারিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ফাইনালটা দেখতে দেখতে গত বছর এই দু’জনের ফরাসি ওপেন ফাইনাল বারবার তুলনায় চলে আসছিল আমার মনে। আর সে কারণে ওয়ারিঙ্কাকে আরও বেশি কৃতিত্ব দেব এ দিন।
রোলাঁ গারোয় জকোভিচকে ও হারিয়েছিল প্রচণ্ড অ্যাটাকিং খেলে। সে দিন ওর কাছে যা বল এসেছিল, মেরে ফাটিয়ে দিয়েছিল। স্লো ক্লে কোর্টে ওই রকম আক্রমণাত্মক শট খুব কমই দেখা গিয়েছে। আর ছিল ওয়ারিঙ্কার অবিশ্বাস্য ব্যাকহ্যান্ড। এমনিতে নিজের দেশের কিংবদন্তি সতীর্থ ফেডেরারের মতো ওয়ারিঙ্কাও এক হাতে ব্যাকহ্যান্ড মারে। এখন বিশ্ব টেনিসে যা প্রায় বিরল দৃশ্য। তবে ওয়ারিঙ্কার ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড যে কোনও দিন ফেডেরারের চেয়ে ভাল। এমনকী এটাই আমার মতে বিশ্বের সেরা ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড।
এ দিন আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের হার্ডকোর্টে কিন্তু দুর্দান্ত ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডের পাশাপাশি খুব ভাল ফোরহ্যান্ডও মেরেছে ওয়ারিঙ্কা। যেটা এই বিগ ম্যাচে ওর জয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। ওয়ারিঙ্কার খেলা দেখে মনে হল, ফরাসি ওপেনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে জকোভিচের বিরুদ্ধে অনেক বেশি গেমপ্ল্যান নিয়ে নেমেছিল। অনেক বেশি ক্যালকুলেটিভ টেনিস খেলেছে।
আন্তর্জাতিক টেনিস ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনে ওয়ারিঙ্কার ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড নিয়েই বেশি লেখালেখি পড়ে থাকি। তার মধ্যেও আমার মতে ওর সেরা শট হল ব্যাকহ্যান্ড ডাউন দ্য লাইন। ওই একটা শটে বিপক্ষের পুরো কোর্টটা ওপেন করে দেয়। রবিবারও প্রায় রাত জুড়ে যে ম্যাচটা দেখলাম, লেফট কোর্ট অর্থাৎ অ্যাডভান্টেজ কোর্ট থেকে ওয়ারিঙ্কা বেশির ভাগ সার্ভিস জকোভিচের এমন ‘ওয়াইড’-এ রাখছিল যে, ওর রিটার্নের উপর স্বচ্ছন্দে নিজের সেরা শট— ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড ডাউন দ্য লাইন মেরে পরের পর পয়েন্ট তুলে নিয়ে চলে যেতে পারল।
তবে জকোভিচও গ্রেট চ্যাম্পিয়ন। হেরেও সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। ওর একটা অসাধারণ গুণ, ম্যাচে নিজে চাপে থাকা অবস্থাতেও বিপক্ষের ভাল শটকে মাথা নাড়িয়ে প্রশংসা করে। কখনওসখনও র্যাকেটে তালি মেরেও করে। এ দিনও সেটা দেখলাম। সবচেয়ে ভাল লাগল, চতুর্থ সেটে যখন দু’পায়েরই বুড়ো আঙুলে ফোস্কার ব্যথায় দু’-দু’বার ‘মেডিক্যাল টাইম আউট’ নিল, ডাক্তার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার সময় একটু দূরে সামান্য বিরক্ত মুখে বসে থাকা ওয়ারিঙ্কাকে হাত নেড়ে দুঃখপ্রকাশ করল। আসলে ম্যাচে পিছিয়ে থাকা প্লেয়ার এ রকম ‘টাইম আউট’ নিলে সাধারণত মনে করা হয়, এগিয়ে থাকা বিপক্ষের মোমেন্টাম নষ্ট হতে পারে। জকোভিচকেও দেখলাম সেটা যেন মেনে নিল ওই সময়!
টিভিতে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই লোকটা আর দু’দিন আগেই সেমিফাইনালে যে লোকটা বিপক্ষের সময় নষ্টের চেষ্টা দেখে রাগে নিজের শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছিল, তারা এক-ই কি না? তার পর মনে হল, সেই ম্যাচে মঁফিসের কোর্টের মধ্যে সময় নষ্টের কারণে হয়তো মেজাজ হারিয়েছিল জকোভিচ। এ দিনের মতো ন্যায্য কারণে সময় নষ্টের ব্যাপার ঘটলে নিশ্চয়ই মেনে নিত।
ফাইনালের চতুর্থ সেটে ম্যাচে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল জকোভিচ। ১-৩ স্কোরে ওয়ারিঙ্কার সার্ভিসে তিন বার ব্রেক পয়েন্ট পেয়েও কাজে লাগাতে পারল না। পারলে কে বলতে পারে নিজের পরের সার্ভিসে ৩-৩ করে ফেলত না জকোভিচ? আর তার পর ম্যাচের রং-ও বদলে যেত না? কারণ ফাইনালের স্ট্যাটিসস্টিকসে দেখছিলাম, প্রায় সব কিছুতেই দু’জনে প্রায় সমান-সমান। এমনকী দু’জনের মোট জেতা পয়েন্টের তফাতও মাত্র এক— ওয়ারিঙ্কা ১৪৪, জকোভিচ ১৪৩। কিন্তু গোটা ম্যাচে দু’জন মোট যত ফুট কোর্ট কভার করেছে তাতে ওয়ারিঙ্কা প্রায় হাজার ফুট এগিয়ে জকোভিচের তুলনায়। তার মানে ফিটনেসে ওয়ারিঙ্কা অনেকটা এগিয়ে ছিল ফাইনালে। আমার তো ওকে শেষ সেটেও ১১০ শতাংশ ফিট মনে হচ্ছিল।
ফাইনালের আগে মনে করা হচ্ছিল, ওয়ারিঙ্কা যেখানে কয়েকটা রাউন্ডে ম্যারাথন ম্যাচ খেলেছে, সেখানে জকোভিচ দু’সপ্তাহে মাত্র তিনটে পুরো ম্যাচ খেলায় অনেক বেশি তাজা থাকবে। কিন্তু টেনিস খেলায় সেটা ভুল ভাবনা। আসলে ঠিক উল্টো হয়ে থাকে। ওয়ারিঙ্কা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যেই ছিল। সেই মোমেন্টামে ছিল। সেখানে জকোভিচ পুরোপুরি ম্যাচ সিচুয়েশনে ছিল না ফাইনালের আগে। মাত্র তিনটে পুরো ম্যাচ খেলার কারণে। দু’জনের এই কন্ডিশনের পার্থক্যটাও ফাইনালে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফাইনালের শেষের দিকে জকোভিচের পায়ের আঙুলে ফোস্কা পড়াটাও এই টুর্নামেন্টে কম ম্যাচ খেলার পরে হঠাৎ-ই একটা লম্বা ম্যাচ খেলার জন্যই।
এ বছরের চারটে গ্র্যান্ড স্ল্যামের দু’টো জকোভিচ, একটা করে মারে আর ওয়ারিঙ্কা জিতল। কিন্তু আমার মতে বছরটা অ্যান্ডি মারের। পরপর উইম্বলডন আর অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আর জকোভিচ চারটের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেও ওকে যেন মনে হচ্ছে পড়তির দিকে।
আসলে শেষ দু’বছর জকোভিচ এমন একটা অবিশ্বাস্য স্ট্যান্ডার্ডের টেনিস ধারাবাহিক খেলেছে, তার পর একটা-দু’টো গ্র্যান্ড স্ল্যামে হারলেই সবার মনে হয়, ওর ফর্ম পড়তির দিকে। নোভাক জকোভিচ নামের এমনই মাহাত্ম্য!