কলকাতা যেমন শনিবারের দুপুরে হাড়ে হাড়ে ভূকম্পন টের পেল, তেমনই কি নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন কলকাতা-কেন্দ্রিক ভূকম্পন অনুভব করবেন?
শনিবার রাতের দিকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার আলিপুরের বাড়িতে প্রভাবশালী বোর্ড সদস্যদের নিয়ে গোপন বৈঠক বসল। আর শেষ হল রাত এগারোটারও পরে। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের শরীরী ভাষা এমনই আক্রমণাত্মক যা দিকনির্দেশ করছে, রোববার চেন্নাই বা লন্ডন যেখানেই থেকে থাকুন, শ্রীনি ভূকম্পন অনুভব করবেন।
চরমপন্থী কোনও কোনও সদস্য মত প্রকাশ করলেন, এখুনি ওকে সাসপেন্ড করা হোক। প্রেসিডেন্টের সাসপেন্ড করার যথেষ্ট আইনি সুযোগও রয়েছে। যেমন ললিত মোদীকে সাসপেন্ড করেছিলেন শশাঙ্ক মনোহর। গরিষ্ঠ মনোভাব কিন্তু এক দিনেই শ্রীনিকে সরাসরি সাসপেনশনের পক্ষে নয়। এই অংশ প্রথমে শো-কজ করে তার পর সাসপেনশনের রাস্তায় যেতে চায়। যদি সেই সুর মেনেই বৈঠক চলে তা হলে কলকাতা বৈঠক হয়তো শ্রীনিকে শো-কজ করবে যে কেন তিনি চেন্নাই সুপার কিঙ্গসের দামটা কমিয়ে দেখিয়েছেন।
সন্ধেবেলা দমদম বিমানবন্দরে নেমে এনসিএ ভাইস চেয়ারম্যান নির়ঞ্জন শাহ বলছিলেন, ‘‘আমাদের যা কিছু শশাঙ্ক মনোহর ঠিক করবেন। উনিই ক্যাপ্টেন।’’ আবার শশাঙ্ক নিজে বলছিলেন, ‘‘আমি ক্যাপ্টেন-ট্যাপ্টেন নই, আসল লোক জগমোহন ডালমিয়া। বোর্ডের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতেই সব ক্ষমতা। এমনকী আর্টিকল ৩৮ অনুযায়ী উনি যদি কাউকে সাসপেন্ড করতে চান (পড়তে হবে শ্রীনিবাসন), সেটা ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন ছাড়াই করতে পারেন।’’
শ্রীনির বিরুদ্ধে অভিযোগ একাধিক। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ দু’টো। এক, সিএসকের ট্রান্সফার মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকায় করানোর অপচেষ্টা। রোববারের ওয়ার্কিং কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত কোনও কোনও সদস্য মনে করেন, বোর্ডকে প্রতারণার দায়ে শ্রীনি এবং আইপিএল সিওও সুন্দর রামন দু’জনকেই এখুনি সাসপেন্ড করা উচিত। তাঁদের মতে, ইন্ডিয়া সিমেন্টসের ব্যালান্স শিটে সিএসকের এখনকার ব্র্যান্ড ভ্যালু দেখানো হয়েছে ছ’শো কোটি টাকা। তা হলে তাকে পাঁচ লক্ষ টাকা বলে চালানো হবে কেন? অর্থাৎ বোর্ডকে তিরিশ কোটি টাকা ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা। এ জন্য শুধু শ্রীনি নন, ওয়ার্কিং কমিটি চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে প্রাক্তন আইপিএল চেয়ারম্যান রঞ্জীব বিসওয়ালের বিরুদ্ধেও। যিনি শেষ কাউন্সিল বৈঠকে এটাকে পাশ করিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে আরও প্রশ্ন উঠতে পারে সুন্দর রামনকে কেন আইসিসিতে বোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হচ্ছে? এক জন বোর্ড সদস্য বলছিলেন, তিরিশ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে আইসিসিতে প্রতিনিধিত্ব করার কি এক জনও নেই যে বোর্ডের একজন চাকুরিজীবীকে পাঠাতে হবে? কেউ কেউ আরও তীব্র কৌতুকে বলছেন, সুন্দর রামন কোন কমিটিতে আছেন গুগলে গিয়ে দেখুন। ও আছে আইসিসির দুর্নীতিদমন সাব-কমিটিতে! সুন্দর কি না দুর্নীতিদমন কমিটির সদস্য! এটা তো বছরের সেরা রসিকতা।
রাতে দশ নম্বর আলিপুর রোডের নীচের তলার ঘরে গিয়ে দেখা গেল বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর, বোর্ডের অঘোষিত নেতা শশাঙ্ক মনোহর, নিরঞ্জন শাহ এবং আইনজীবী উষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমায়েত এক রকম বসে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে রোববার সকালে এসে পড়তে পারেন শরদ পওয়ারও। ডালমিয়ার আমলে প্রথম ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে বাংলার কে প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা নিয়ে স্থানীয় ক্রিকেটমহলে প্রবল কৌতূহল। শশাঙ্করা যেহেতু সৌরভের প্রতি খুব সদয় তাতে সিএবি থেকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করলে অবাক হওয়ার থাকবে না।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ক্রিকেট কমিটিতে মনোনয়নের ব্যাপারে এ দিন কথা হল। কথা হল সৌরভ-সচিন-রাহুল তিন জনকেই যেন নতুন ক্রিকেট কমিটি গড়ে রাখা হয়। নতুন এই কমিটির কাজ হবে ক্রিকেট-সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়া। জাতীয় দলের কোচ ঠিক করা। সার্বিক ক্রিকেট-নীতি প্রণয়ন করা। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল যেমন আইপিএল চলার সময়ই কাজ করে, এই কমিটি তেমন নয়। এই কমিটি কাজ করবে সারা বছর।
সৌরভকে এখনই কোচ করা নিয়ে যদি বা মতদ্বৈধ থেকে থাকে, কমিটিতে নেওয়া নিয়ে নেই। আপাতত প্রশাসক সৌরভ যদি ওয়ার্কিং কমিটিতে যান, প্রথম দিনই নানা বিস্ময় তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। যেমন কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে পুরনো জমানায় চোদ্দো কোটি টাকা বোর্ডের তহবিল থেকে লন্ডন-অবস্থিত একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালী বোর্ড সদস্যদের ই-মেল এবং ফোন ট্যাপ করার জন্য! এই অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তখনকার বোর্ড সচিব সঞ্জয় পটেল শাস্তির মুখে পড়বেন। কারণ সরকারি ভাবে এজেন্সি মনোনয়নের নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নন। এই সংস্থা নাকি নির্বাচনের আগে প্রভাবশালী বোর্ড সদস্যদের ই-মেল খতিয়ে দেখেছে। কে কার সঙ্গে কথা বলেছেন, তা নিয়ে খোঁজখবর করেছে। সচিব অনুরাগ ঠাকুরকে বলা হয়েছে এ ব্যাপারের সত্যতা অনুসন্ধান করতে।
আইসিসিতে শ্রীনির প্রতিনিধিত্ব করে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এক কথায় নানা দিক থেকে শ্রীনিকে বিঁধবেন বোর্ড কর্তারা। তাঁর হয়ে কি বক্তব্য রাখবেন কেউ? শনিবারের মেজাজ দেখে মনে হল না কারও সেই সাহস হবে বলে। বোর্ডে গত কয়েক বছর এটাই দস্তুর ছিল যে শ্রীনি বলবেন, বাকিরা শুনবেন। রোববারের কলকাতা হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন বার্তা বয়ে আনবে!