বীরভূমের রাঙামাটি না এ বার অ্যাঞ্জেলোদেরই চাপা দেয়

ঘোর ক্রিকেট-মূর্খও জানে টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনের শেষটা যে কখনও গোটা টেস্টের টার্নিং পয়েন্ট খোঁজার উপযুক্ত সময় নয়। ফিল্মের ফার্স্ট হাফই শেষ হল না। সেটার সমালোচনা কী করে শুরু হতে পারে?

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলম্বো শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

ঘোর ক্রিকেট-মূর্খও জানে টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনের শেষটা যে কখনও গোটা টেস্টের টার্নিং পয়েন্ট খোঁজার উপযুক্ত সময় নয়। ফিল্মের ফার্স্ট হাফই শেষ হল না। সেটার সমালোচনা কী করে শুরু হতে পারে?

Advertisement

ক্রিকেট ফিল্মের চেয়ে এ জন্যই আলাদা কারণ সে এগোতে এগোতে কিছু সংকেত রেখে যায়। সংকেতগুলো জুড়ে-টুড়ে ঠিক উত্তরে পৌঁছনো যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই কিন্তু একটা আন্দাজে তো পৌঁছনো যায়।

ওভাল টেস্টের পয়লা নম্বর টার্নিং পয়েন্ট যেমন দাঁড়াতে পারে এখানকার স্বাভাবিক পিচের ধর্মকে পরিবর্তন করতে চেয়ে শ্রীলঙ্কার স্পিনিং করার চেষ্টা। সকালে বিরাট কোহলি টস করতে এসে বলেই ফেলেন, ‘‘উইকেট দু’দিন আগে যা দেখেছিলাম আর আজ যা দেখছি সম্পূর্ণ আলাদা।’’ বাংলা কথা, উইকেটের ওপর ডাক্তারি হয়েছে। এ ধরনের ক্যাটক্যাটে কথা আজকাল কেউ আর বলে না। টসে পিআর মার্কা কিছু মামুলি আদানপ্রদান করে চলে যায়। কিন্তু কোহলি বোধহয় আর রাগ সামলাতে পারেননি। ওভাল পিচ তো সত্যি ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!

Advertisement

কাল লিখেছিলাম তৃণমূলীয় সবুজ থেকে আলিমুদ্দিন রঙা সারফেস করার চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা। দোষও দেওয়া যায় না। গলে ভারতের জেনারেশন ওয়াইয়ের যে ব্যাটিং তারা স্পিনিং সারফেসে দেখেছে তাতে ২-০-র সুযোগ তো দ্রুত নেবেই। পিচটা অবশ্য ইট লাল হয়নি। রাঙা একটা কালার এসেছে যাকে দূর থেকে বীরভূমের রাঙামাটি মনে হতে পারে। এমন রাঙামাটির পথ অবশ্যই রঙ্গনা হেরাথের জন্য তৈরি। যে তাঁর বাঁ হাতি স্পিনের ছোবল এখানে এক-একটা কামড় দেবে আর সেই বিষ ছড়িয়ে পড়বে গোটা ভারতীয় ইনিংসে।

ডিজাইনে কাজ হয়নি দেখাই যাচ্ছে। ৩১৯-৬ হাতে নিয়ে প্রথম দিনের যুদ্ধে ভারতই এগিয়ে। শুধু ১২ রানে ২ উইকেটের ত্রাস থেকেই নিজেদের বাঁচিয়ে নেয়নি। এমন পটভূমি তৈরি করেছে যেখানে ফোর্থ ইনিংসে ওভালের এই রাঙামাটির পথ শ্রীলঙ্কানদের দিকেই উল্টে ধেয়ে আসতে পারে।

পি সারার সাবেকি চরিত্র পেসার সহায়ক। শ্রীলঙ্কা তো তাদের দ্রুততম দুষ্মন্ত চামিরাকে খেলালও। চামিরা গড়ে ১৪৬ কিলোমিটার গতিতে বল করলেন। কিন্তু তিনি যে পাদানির ওপর দাঁড়িয়ে বিভীষিকা হতে পারেন, সেটাকে তো তাঁর দলই উড়িয়ে দিয়েছে। স্রেফ ভারত কীসে বেশি বিপন্ন হবে ভেবে। আর কোহলির ভারত যে ভাবে ব্যাট করেছে তাতে একটা বিবৃতি খুব স্পষ্ট— যেতে পারি কিন্তু একা কেন যাব। এই হেরাথ না কী, তোকে নিয়ে যাব।

গলের শেষ দিন ঠিক যা যা চাওয়া হয়েছিল সেগুলোই যেন উপুড় করলেন ব্যাটসম্যানরা। হেরাথকে তিন জনই ছক্কা মারলেন। কোহলি, লোকেশ আর রোহিত। হেরাথের প্রতি ব্যাটিং ইউনিটের মনোভাবে কোথাও যেন সম্মিলিত সম্মানের প্রশ্নও জড়িয়ে গিয়েছে। এ দিন দু’টো উইকেট তুললেন ঠিকই কিন্তু গলে তাঁর বাঁ হাতি স্পিন যদি ফণা তোলা বিষধর হয়ে থাকে আজ ছিল নেহাতই ঢোঁড়া!

কুর্নিশ

অন্য গোলার্ধের আর এক ওভাল। বৃহস্পতিবার।

সকাল সওয়া আটটা নাগাদ তাজ সমুদ্র হোটেলে ব্রেকফাস্ট সারতে গিয়ে স্টুয়ার্ট বিনির মতো কাউকে দেখলাম। টোস্টার থেকে সেঁকা পাউরুটি বার করছেন। অদ্ভুত মিল আসল বিনির সঙ্গে। তার পর দেখি এটাই স্টুয়ার্ট বিনি! পাশে উমেশ যাদব শেফের কাছ থেকে ফ্রায়েড এগ সানি সাইড আপ বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চোখ কপালে ওঠার মতো দৃশ্য!

দশটায় টেস্ট ম্যাচ শুরু। সাড়ে ন’টায় টস। আর টিম এই সাড়ে আটটা নাগাদ জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে! এ তো ভাবাই যায় না। আগেকার দিনের কোচেরা বলতেন, খেলা শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগে অবধি যা খাওয়ার খাও, তার পর স্যুপ বা লিকুইড কিছু। খুব বেশি হলে এক পিস স্যান্ডউইচ চলতে পারে। টিমের তো ওয়ার্ম আপ শুরু হওয়ার কথা সাড়ে আটটায়। ক্রিকেট-ডায়েটিশিয়ানরা কি সব বদলে দিয়েছেন?

সৌভাগ্যবশত কিছু জিনিস আজও বদলায়নি। যেমন অফ স্টাম্পের বাইরে টেস্ট ম্যাচে বল ছাড়ার টেকনিক। আজও অফ স্টাম্পটা কোথায়— ব্যাটসম্যানকে বুদ্ধিদীপ্ত নতুন বল আক্রমণের বিরুদ্ধে খেয়াল রাখতে হয়। আজও ব্যাট নিয়ে দাঁড়ানোর সময় পুরনো ঘরানার ট্যাপ অ্যান্ড আপ না করলে ব্যাটসম্যান বিপন্ন হয়। যবে থেকে ক্রিকেট হচ্ছে সব সময় বল দেখার সময় ব্যাটসম্যান ব্যাট দিয়ে মাটিতে ট্যাপ করে আবার ওপরে তোলে-নামায়। এই ট্যাপিং ও তোলাটা আধুনিক যুগে প্রায় নেই। কোহলি করেন। মাইকেল ক্লার্ক করেন। কিন্তু বাকিরা প্রায় করে না। কারণ ব্যাটের ওজন এত বেড়ে গিয়েছে যে ট্যাপ অ্যান্ড আপ বারবার করতে গেলে অনেক শক্তিক্ষয় হয়। আধুনিক ব্যাটসম্যান তাই আর ব্যাটটা মাটিতে ট্যাপ করে না। গ্রাহাম গুচের মতো ওপরে ধরে রাখে। আধুনিক ঘরানার বিপদ হল, হাতের কোনও মুভমেন্ট যেহেতু বল দেখার সময় হচ্ছে না হঠাৎ করে বাঁ হাত লক্ড হয়ে যেতে পারে।

তিন নম্বরে প্রোমোশন পাওয়া অজিঙ্ক রাহানের ঠিক তাই হল! বাঁ হাতটা চলে গেল স্লিপকে প্র্যাকটিস ক্যাচ দিয়ে। মুরলী বিজয় তার আগেই ফিরে গিয়েছেন ম্যাচের প্রথম ওভারে। আজকের সেঞ্চুরিকারী লোকেশ রাহুল যখন গালিতে সহজ ক্যাচ তুললেন তখন বোর্ড দেখানো উচিত ২০-৩। টুইটারে পোস্ট করা উচিত সঙ্গকারার বিদায়ী টেস্টে ভারত বিপর্যয়ের মুখে।

অথচ ক্যাচটা ফেলে দিলেন মুবারক। খুব দ্রুত গেছিল বলটা ঠিকই। কিন্তু গালি ফিল্ডার তো ওই রকম ছিটকে যাওয়া বলই ধরবে। গালি ক্যাচিং মানেই তো রিফ্লেক্স ক্যাচিং।

ওই একটা ক্যাচ মিস গোটা দিনের রূপরেখা বদলে দিল। কোনও ক্রিকেটপ্রেমী কবি ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে গেলে হয়তো খুঁজে পেতেন একই দিনে সহজতম ক্যাচের মৃত্যু ও কঠিনতম ক্যাচের জন্ম!

বিরাট কোহলির সেঞ্চুরিটা স্লিপে যে এক হাতের ক্যাচে অ্যাঞ্জেলো রুখলেন সেটা তো সত্যিই কঠিনতম এবং সিরিজ সেরা ক্যাচের নমিনেশনে নির্ঘাত ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক খেলাধুলোর ঘোর বাস্তবতায় রোম্যান্টিক কবিত্বের কোনও স্থান নেই। সেখানে সব কিছুই গদ্যময়। ওই একটা লোক গালিতে ক্যাচটা পড়ার পর কোহলির সঙ্গে ১৫৮ রানের পার্টনারশিপ করে গেল। নিজের রান সেঞ্চুরি-সহ বাড়িয়ে নিল আরও ৯৬। কে বলতে পারে ক্যাচটা ধরতে পারা এবং না পারার মধ্যেই হয়তো সঙ্গার বিদায়ী টেস্ট ঝুলে থাকল!

কোহলি আবার দারুণ ব্যাট করলেন। বাকি ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে তাঁর জাতের এত তফাত যে ক্রিকেট দেখে না এমন লোকও মুহূর্তে ধরে ফেলবে। দু’পায়েই অসম্ভব ভাল ব্যালান্স। ফুটওয়ার্কে ভুল করার সম্ভাবনা খুব কম। লোকেশ রাহুলকে গাইড করে-করে নিয়ে গেলেন কোহলি। লোকেশের (রাহুল ডাকটা এখনও এক জনের থাকাই ভাল) টেস্ট জীবন সত্যিই আজব। চার টেস্টে দু’টো সেঞ্চুরি হয়ে গেল। কিন্তু বাকি ইনিংসের সব রানই সিঙ্গল ডিজিটের। পুল করেন। বল ছাড়েন ভাল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তাঁর অভিজাত অনড্রাইভ যা টি-টোয়েন্টি অত্যাচারে ক্রিকেটে ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

রোহিতকে নীচে যে ভাবে নামিয়ে তাঁকে প্রতিরক্ষা দিলেন কোহলি সেটা জামাইআদর তুল্য। এ দিনের মতো রোহিত তার অপব্যবহার করেননি। তাঁর সমস্যা সামনে খেললেই। আবার তিনি পাঁচে চলে গেলে উপযুক্ত ছয় নম্বর নেই। রাহানের তিন নম্বর খেলা আর স্টুয়ার্ট বিনির ছয়— দু’টোই একই রকম বিভীষিকা! আর চরম দুঃখেরও— কারণ একটা জায়গা ছিল দ্রাবিড়ের। একটা লক্ষ্মণের।

অ্যাঞ্জেলোকে দিনের শেষে দেখে মনে হল তৃণমূলীয় রং রাখলেই যে তাঁর উপকার হত, সেটা বোধহয় বুঝেছেন। নইলে এত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় নতুন বল নিতেন না। এই টেস্টের অনেক রং বদল বাকি তবে গলের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তফাত, এখানে হোম টিম খেলবে পরে। সফরকারী দলের প্রথম ইনিংসের সাড়ে তিনশো আসলে চারশো।

এমনিতে দিনের উত্তেজনা বলতে ওই ক্যাচ পড়ার মুহূর্তটাই। সঙ্গাকে ফিল্ড করতে নামার সময় ব্যাট তুলে গার্ড অব অনার দিল তাঁর টিম। যার মধ্যে রাস্তা করে তিনি মাঠে ঢুকলেন। কিন্তু দর্শকদের গার্ড অব অনার কোথায়? দু’হাজার লোকও ছিল কি না সন্দেহ। নাকি তারা ব্যাটসম্যান সঙ্গাকেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হিসেবে চেনে। শ্রীলঙ্কা ব্যাট করার সময় পিলপিল করে ঢুকবে?

টেস্ট ম্যাচ ঘিরে এ দেশের যা জাগতিক আগ্রহ তাতে বিশেষ ভরসা হয় না। রোদচশমা আর ডিজাইনার শার্টে পেটানো চেহারার যুবক অবশ্য সারা দিনই বসে খেলা দেখলেন। সঙ্গা অ্যাকশনের ভেতর ছিলেন কী ছিলেন না তাতে কিছু আসে যায় না। বিদায়বেলায় বন্ধুর পাশে পাঁচ দিন থাকবেন বলে দূর ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। প্রতিটা মিনিটই ওভালে থাকবেন।

তিনি— মাহেলা জয়বর্ধনে। এবিপিকে বললেন, গোটা ম্যাচটা তারিয়ে উপভোগ করতে চান। ধন্য এমন বন্ধুত্ব!

ভারত

প্রথম ইনিংস

বিজয় এলবিডব্লিউ প্রসাদ ০

রাহুল ক চণ্ডীমল বো চামিরা ১০৮

রাহানে ক করুণারত্নে বো প্রসাদ ৪

কোহলি ক ম্যাথেউজ বো হেরাথ ৭৮

রোহিত এলবিডব্লিউ ম্যাথেউজ ৭৯

বিনি ক চামিরা বো হেরাথ ১০

ঋদ্ধিমান ন.আ. ১৯

অতিরিক্ত ২১

মোট ৩১৯-৬।

পতন: ৪, ১২, ১৭৬, ২৩১, ২৬৭, ৩১৯।

বোলিং: প্রসাদ ২০-৫-৭২-২, ম্যাথেউজ ১০.২-৪-১৭-১,

চামিরা ১৩-০-৫৯-১, হেরাথ ২১-২-৭৩-২, কৌশল ২৩-২-৮২-০।

ছবি: এএফপি ও দেবাশিস সেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement