দেল বস্কির এই স্পেন শুধু তিকিতাকায় আটকে নেই

শুক্রবার রাতের স্পেনের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, দুর্দান্ত সিমফনি দেখছি। প্রতিটা পাস, প্রতিটা মুভ, প্রতিটা টাচ এক একটা সুন্দর গোল তৈরি করতে সাহায্য করছিল। আর এই ‘স্প্যানিশ অর্কেস্ট্রা’র কনডাকটর ছিল এক জনই— আন্দ্রে ইনিয়েস্তা।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০৯:৩০
Share:

শুক্রবার রাতের স্পেনের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, দুর্দান্ত সিমফনি দেখছি। প্রতিটা পাস, প্রতিটা মুভ, প্রতিটা টাচ এক একটা সুন্দর গোল তৈরি করতে সাহায্য করছিল। আর এই ‘স্প্যানিশ অর্কেস্ট্রা’র কনডাকটর ছিল এক জনই— আন্দ্রে ইনিয়েস্তা। যার সৌজন্যে স্পেনের ফুটবল এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই, ইনিয়েস্তাই এই টিমটার লিডার। জাভি, তোরেস, ভিয়াদের ছেড়েও ইনিয়েস্তার জন্যই এই দলটা ইউরো জেতার বড় ফেভারিট।

Advertisement

আলভারো মোরাতার ২২ টাচের দ্বিতীয় গোলটা দেখে অনেকের মনে হতে পারে, সেই এক তিকিতাকার জোরেই আর এক বড় টুর্নামেন্ট জিততে চায় স্পেন। কিন্তু আমি বলব, এই স্পেন মানেই শুধুমাত্র তিকিতাকা নয়। তিকিতাকা মানেই তো খুব স্লো পাসিং। ছোট ছোট পাস। খুব বেশি ডায়গোনাল বল না বাড়ানো। কিন্তু দেখলাম এই স্পেন লং বলও যেমন খেলছে, তেমন এক ফ্ল্যাঙ্ক থেকে আর এক ফ্ল্যাঙ্কে সুইচ অব প্লেও করছে। পুরনো স্পেন একটা মুভের পিছনে অতিরিক্ত বেশি সময় নষ্ট করত। ওদের কয়েকটা পাসিং জোন থাকত। তার বাইরে বেরোত না। এতে বিপক্ষ আগেভাগেই ধরে ফেলছিল স্পেনের মুভমেন্ট।

এখন কিন্তু স্পেন তিকিতাকার সঙ্গে ডিরেক্ট ফুটবলের মিশেলটাও দারুণ ভাবে এনেছে। মোরাতার প্রথম গোলটা তো নলিতোর ক্রস থেকে হল। স্পেনকে এতটা ডিরেক্ট গোল দিতে শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ছে না। আসলে বিশ্ব ফুটবল শাসন করতে হলে আপনাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের খেলার ঘরানা পাল্টাতে হবে। বিপক্ষের স্টাইল অনুযায়ী নিজেদের সিস্টেম প্ল্যান করতে হয়। আগে এই জিনিসটা করত ব্রাজিল। এখন সেটা রপ্ত করেছে স্পেন। আমি বলছি না যে তিকিতাকাকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দিয়েছে স্পেন। তৃতীয় গোলটাই তো ছিল ভিন্টেজ তিকিতাকা গোল। ২২টা পাস খেলে ছবির মতো। কিন্তু আগে যেখানে স্পেনের খেলা নব্বই শতাংশ ছিল তিকিতাকা ফুটবল, এখন সেটা কমে হয়তো হয়েছে পচাত্তর শতাংশ। বাকি পঁচিশ শতাংশে ঢুকেছে লং বল, ডায়গোনাল পাস।

Advertisement

স্পেনের এই বিবর্তনের জন্য ভিসেন্তে দেল বস্কির প্রশংসা করতে হবে। ২০১০ বিশ্বকাপে দেখেছিলাম স্পেন একটা গোল দিয়েই খুশি থাকত। কিন্তু এখনকার স্পেন একটা গোল দিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। বিপক্ষ আবার চেপে ধরার আগেই শেষ করে দিচ্ছে ম্যাচ। ফুটবলে একটা কথা চালু আছে, ‘‘কিল ওয়েন ইউ হ্যাভ দ্য চান্স।’’ অর্থাৎ সুযোগ যখন পাবে তখনই মেরে দাও। তুরস্কের বিরুদ্ধে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দুটো গোল করেই তো ম্যাচটা শেষ করে দিল মোরাতারা। আক্রমণে গিয়ে যখন গোলে শট নেওয়ার সুযোগ থাকছে তখন স্পেন সেটা নিচ্ছে। বেকার পাস খেলে মুভ নষ্ট হতে দিচ্ছে না।

মনে পড়ে যাচ্ছে, স্যর ববি রবসনের কথা। স্যর ববি রবসন তখন কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর পিএসভি আইন্দোভেনকে নিয়ে। মনে আছে, একটা ম্যাচের মাঝপথে জাম্বিয়ান ফুটবলার কালুশা বলওয়াকে তুলে নিয়েছিলেন। ম্যাচের পরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘বলওয়া এত সুন্দর ড্রিবল করছিল, তা হলে তুললেন কেন?’’ রবসন আমায় উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘ড্রিবল করে সময় নষ্ট হচ্ছিল। আমার ড্রিবলের থেকেও বেশি দরকার ছিল থ্রু পাস। যাতে গোলটা দ্রুত আসে।’’ দেল বস্কিও মনে হয় ঠিক সে রকমই পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের টিমের ফুটবলটা বদলে দিচ্ছেন। যেখানে তিকিতাকায় আবদ্ধ না থেকে অনেক বেশি দ্রুত মুভ তৈরি করছে স্পেন।

দু’বছর আগের আর এখনকার স্পেনে বদল এলেও একটা ব্যাপার বদলায়নি। সমান অপ্রতিরোধ্য রয়ে গিয়েছে আন্দ্রে ইনিয়েস্তা। হতে পারে ইনিয়েস্তা ব্যালন ডি’অর পায়নি। তাতেও বলব ও কোনও ব্যালন ডি’অর জয়ীর থেকেও কম কিছু নয়। কী অসাধারণ প্রতিভা। ছোট জায়গায় দুরন্ত ড্রিবল। তিন-চার জন ডিফেন্ডারকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। এ রকম ফুটবলারকে দেখতেই তো রাত আড়াইটে অবধি জেগে থাকা। ইয়র্দি আলবার পাস থেকে তৃতীয় গোলটায় মোরাতার ফিনিশটা সহজ ছিল। কিন্তু আলবাকে সঠিক টাইমিংয়ে ইনিয়েস্তার বাড়ানো থ্রু-বলটাই এক কথায় ছিল মিডাস টাচ।

স্পেনের পাসিং এত কেন ভাল ব্যাখ্যা করতে হলে বলব ওরা খুব বেশি ঝুঁকিতে যায় না। নিশ্চিত বলগুলোই পাস ঠেলে। সব সময় নিজেদের অর্ধে পাস খেলে। গোলকিপার দে হিয়াও তো শর্ট পাস খেলে ব্যাকলাইন থেকে মুভ তৈরি করছিল। টুর্নামেন্ট যত এগোবে স্পেনের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হবে। কিন্তু ওদের হাতে একটা অস্ত্র আছে। খুব ভাল, দ্রুতগতির টিমের সামনে পড়লে ওরা ম্যাচকে স্লো করে দিতে পারে। টেম্পোটা নিজেদের হাতে রাখে। আর যখন সুযোগ পাবে, তীব্র গতিতে আক্রমণটাও করবে। সেই ক্ষমতা আছে দেল বস্কির দলের।

এই স্পেন অনেক দূর যাবে না তো কে যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement