বহু বছর বাংলা ছেড়েছি। অবাঙালি পরিবারের বউ— সেও অনেক বছর হয়ে গেল আমার। কিন্তু মনেপ্রাণে এখনও আমি সেই জলপাইগুড়ির বাঙালি-ই! এখনও রোজ সকালে স্নান সেরে ঠাকুরঘরে ঢোকার অভ্যেস। কিন্তু কাল আরও অনেক বেশিক্ষণ ধরে আমার আরাধ্য দেবতাকে মনে মনে ডাকব। আমাদের মেয়েটার নামে মা কালীর পায়ে পুজো চড়াব। হ্যাঁ, পিভি সিন্ধুর অলিম্পিক্স সোনা জয়ের পথে শুক্রবার আর কোনও রকমের বাধা যেন না থাকে!
দেশের একজন মেয়ে খেলোয়াড় হিসেবে আজ অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ আর তৃপ্তি হচ্ছে আমার। অলিম্পিক্সের আশি ভাগ সময় হাত খালি থাকার পরে আমাদের দেশের ঝুলিতে এক দিনে দু’-দুটো পদক। আর দুটোই মেয়েদের দাপটে। লন্ডনের রেকর্ড ভারত রিওতে ভাঙতে পারছে না ঠিক। ছ’টার অর্ধেকও এ বার আসবে কি না সন্দেহ। কিন্তু এ বারের গেমসে একটা খুব বড় সত্য প্রতিষ্ঠিত। সেটা হল, ভারতীয় নারীশক্তির জয়!
রোহতকের অজ গাঁ থেকে হাজারো সমস্যা মাটিতে আছড়ে ফেলে সাক্ষী মালিকের কুস্তির ব্রোঞ্জ আমাদের কাছে সোনার পদকের চেয়েও দামী। তেমনই পিভির অলিম্পিক্স ব্যাডমিন্টন ফাইনাল খেলতে চলা আমাদের দেশের খেলাধুলোর মামুলি পরিকাঠামোয় আমার কাছে প্রায় অলৌকিক ঘটনা! মানছি সাইনা নেহওয়ালের অলরাউন্ড স্কিল, ধারাবাহিকতা, বেশ কিছু সুপার সিরিজ, প্রিমিয়ার সুপার খেতাব, অলিম্পিক্স ব্রোঞ্জ— সব আছে। কিন্তু অলিম্পিক্স ফাইনাল হল অলিম্পিক্স ফাইনাল। সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আলাদা স্টেজ। আবহ। সেখানে আমাদের একটা মেয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে নামছে, ভাবলেই যেন আনন্দ-উত্তেজনায় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার-ই। পিভির তা হলে মনের ভেতর কী চলছে এক বার ভাবুন!
কিন্তু প্লিজ, ভাববেন না। পিভিকে যত দূর দেখেছি, ট্রেনিং করিয়েছি, কোর্টের বাইরে দু’জনে মিলে সময় কাটিয়েছি— আমি নিশ্চিত ও বিশ্বের এক নম্বর ক্যারোলিনা মারিনের বিরুদ্ধে অলিম্পিক্স ফাইনাল নিয়ে আর যাই হোক, টেনশন করবে না। এই চব্বিশ ঘণ্টা পিভি আর কোচ গোপী যা ভাবার নিশ্চয়ই ভাবছে ম্যাচটার স্ট্র্যাটেজি, এক্সিকিউশন, গেমপ্ল্যান নিয়ে। না হলে এ দিন সেমিফাইনালে এ রকম অবিশ্বাস্য দাপট দেখাতে পারত না পিভি। গত এক বছরে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে সবচেয়ে উত্থান ঘটানো প্লেয়ার ওকুহারাকে শুধু প্রথম বার সিনিয়র লেভেলে হারালই না, স্রেফ উড়িয়ে দিল ২১-১৯, ২১-১০। টেনশনে ভোগেনি বলেই।
তবে একটা ব্যাপার আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। ভাবতে পারিনি, ওকুহারার মতো প্লেয়ারের বিরুদ্ধে পিভি এ রকম দাপট দেখিয়ে জিতবে। কী ভাবে পিভি নিজেকে এতটা উঁচুতে তুলে আনতে পারল?
বুঝলাম পিভির হারানোর কিছু ছিল না। এই বড় ম্যাচটায় তো বটেই, রিওতেই তো ও আন্ডারডগ। কেউ ভাবেনি সাইনা গোড়াতে ছিটকে যাবে আর পিভি মেডেল রাউন্ডে পৌঁছবে! কিন্তু নিজে এই লেভেলে খেলেছি বলে টিভিতেই পিভির খেলা দেখে বুঝতে পারছি, মাস কয়েক আগের চেয়েও এখন ওর ফিটনেস কতটা বেশি। কতটা পাওয়ার বেড়েছে ওর প্রায় সব ধরনের স্ট্রোকে। কী পরিমাণ স্পিড বেড়েছে কোর্টে। ওকুহারাকে প্রচণ্ড গতি, পাওয়ার আর প্লেসিংয়ে পুরো কোর্ট দৌড় করিয়ে বেদম করে তুলল। স্ম্যাশ, হাফস্ম্যাশ, ড্রপ শট, লং সার্ভিস, শর্ট সার্ভিস, নেটের সামনে প্লেসিং— কোন স্ট্রোকে না নাস্তানাবুদ করেছে! যে জন্য দ্বিতীয় গেমে একবার মাত্র ছাড়া গোটা ম্যাচে পয়েন্টে এগিয়ে ছিল পিভি। আর দ্বিতীয় গেমের টাইম আউটে ১১-১০ থেকে টানা এগারো পয়েন্ট তুলে ম্যাচ সাঙ্গ করে দিল। দৌড়ে ততক্ষণে ওকুহারা কাহিল। শেষের দিকে তো অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নকে দেখে মনে হচ্ছিল, বেচারা ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছে!
পিভির আর একটা ব্যাপার খুব ভাল লাগছে। বিশ্বের দু’নম্বর ইহানকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে ও যেন আরও বেশি ফোকাস়ড্। সাধারণত একটা বড় ম্যাচ জিতলে সামান্য হলেও মনে একটা হালকা ভাব এসে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমার নিজের কেরিয়ারে হয়েছে। বিরানব্বইয়ের অলিম্পিক্সে প্রথম ম্যাচ জিতে আমার এত আনন্দ হয়েছিল, পরের রাউন্ডে ফোকাস একটু নড়ে গিয়েছিল। হেরেছিলাম। পিভিকে কিন্তু ইহানকে হারানোর পরে ওকুহারার সামনে আরও বেশি ফোকাস়ড দেখাল। টিভিতে ওর মুখটা যখনই জুম করছিল, দেখে মনে হল দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে! প্রচণ্ড একরোখা লাগছিল।
এই অদম্য জেদ, প্রচণ্ড ফোকাস কিন্তু দেশকে অলিম্পিক্স সোনা এনে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিভিকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের নতুন রানি করে দিতে পারে! ঠাকুরের কাছে আমার প্রার্থনা নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না।