জয়ের পর সিন্ধু। আজ সেমিফাইনালে তাঁর লড়াই ভারতীয় সময় সন্ধে সাড়ে সাতটায়, স্টার স্পোর্টসের চ্যানেলগুলিতে। ছবি: পিটিআই।
মাত্র দশ মাস আগের কথা। ছাত্রীর নরম-সরম মনোভাব আর জড়তা কাটাতে অদ্ভুত একটা টোটকা বাতলেছিলেন পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধুর কোচ গোপীচন্দ। ছাত্রী এক দিন তাঁর অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করতে আসার পর নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘‘তুমি কোর্টের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করবে। আর চার দিকে দাঁড়িয়ে দেখবে অ্যাকাডেমির সব কোচ, ছাত্র-ছাত্রী!’’ কোচের নির্দেশ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সিন্ধু। কিছুতেই কোর্টে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। গোপী তাঁকে বলেন, ‘‘ওটা না করলে র্যাকেটই ছুঁতে দেব না।’’ বাধ্য হয়ে দীর্ঘক্ষণ চিৎকার করেছিলেন সিন্ধু। এবং তার পরেই তাঁকে র্যাকেট নিয়ে কোর্টে নামতে দিয়েছিলেন কোচ।
সেই মেয়েই যখন বিশ্বের দু’নম্বর, চিনের ইহান ওয়াংকে অলিম্পিক্স ব্যাডমিন্টনের কোয়ার্টার ফাইনালের মরণপণ লড়াইয়ে ২২-২০, ২১-১৯ হারিয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন— তখন মনে হল, কোচের টোটকাটা অব্যর্থ ছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বীর জোরালো স্ম্যাশ আর প্লেসিংয়ের কাছে বেশ কয়েক বার কোণঠাসা হয়ে পড়ার সময় দেখছিলাম, গোপীচন্দ রাগী চোখে বারবার সিন্ধুকে আক্রমণাত্মক হতে বলছেন। আর অবিশ্বাস্য ভাবে তার পরেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন ছাত্রী। যাঁর বাবা-মা দু’জনেই জাতীয় ভলিবল দলের প্রাক্তন সদস্য, বাবা রামান্না খেলেছেন এশিয়ান গেমসেও।
পায়ে কমলা স্পোর্টস-শু। ব্রাজিল সমর্থকদের পছন্দের উজ্জ্বল হলুদ টিউনিকের বুকে সাঁটা জাতীয় পতাকা। গলার সরু সোনার চেনটা চকচক করছে ঘামে। বিশ্বের দু’নম্বরের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ জিতে ওঠা সিন্ধুকে নিয়ে তখন পুরো স্টে়ডিয়াম মাতোয়ারা। সেমিফাইনালে ওঠা মেয়ে সেই অভিবাদন গ্রহণ করে র্যাকেট হাতে দৃপ্ত যখন হেঁটে আসছিলেন মিক্সড জোনের দিকে, মনে হচ্ছিল, এ বার হয়তো সত্যিই পদকের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে ভারত।
থুতনির ঠিক মাঝখানে একটা তিল। হাসলে খুব মিষ্টি দেখায় শ্যামলা মেয়েকে। উচ্ছ্বাসে, তৃপ্তিতে সত্যিই ভাসছিলেন সিন্ধু। বলছিলেন, ‘‘এটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা বলতে পারেন। ইহানের বিরুদ্ধে আগে জিতেছি, হেরেওছি। কিন্তু অলিম্পিক্স তো অন্য মঞ্চ। এখানে জেতার আনন্দটাই আলাদা!’’
গত বারের রুপোজয়ী চিনা মেয়ের সঙ্গে তাঁর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষের পরেও রিওসেন্ট্রোর অ্যাড্রেস সিস্টেম বলে যাচ্ছিল, ‘‘কী অসাধারণ কোর্ট দখলের লড়াই!’’ বলতেই হবে। প্রথম সেটে ১৫-১৫, ১৬-১৬, ১৯-১৯, ২০-২০। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল চলবে এই র্যালি। ২০-২০ হওয়ার পর বিরতিতে দেখলাম, গোপী তাঁর ছাত্রীকে বলছেন, ‘‘ওর বাঁ দিকটা দুর্বল। ও দিকেই আক্রমণ করো।’’ অবিশ্বাস্য ভাবে পরের দু’টো পয়েন্ট সিন্ধু তুললেন ইহানকে বাঁ-দিকে খেলতে বাধ্য করেই।
প্রথম গেম ২০-২২ হেরেও হাল ছাড়েননি ইহান। চিনা মেয়ের ফিটনেস চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, যে কোনও জায়গা থেকে সিন্ধুর শটগুলো ফেরাচ্ছিলেন অবলীলায়। তবে পরের সেটের শুরুর দিকে খানিকটা নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়েই ১৭-১৩ এগিয়ে গেলেন সিন্ধু। স্টে়ডিয়াম জুড়ে তখন চিৎকার, ‘‘পি…. ভি…… সিন্ধু।’’ কে ভেবেছিল, এর পরেও নাটক আছে! ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেন ইহান। পয়েন্ট পেতে পেতে একটা সময় টপকেও গেলেন সিন্ধুকে।
১৮-১৯। উৎকণ্ঠার শিরশিরানি গ্যালারিতে। এই পিছিয়ে থাকা অবস্থাতেই পরপর দু’টো ভাল সার্ভ করলেন সিন্ধু। ব্যাস, তাতেই বাজিমাত!
এই মুহূর্তে পদকের থেকে ঠিক একটা জয় দূরে ভারতীয় মেয়ে। তবে সিন্ধু নিজে বললেন, ‘‘পদকের কথা মাথায় রাখছি না। শুধু নিজের খেলায় ফোকাসটা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি।’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘আজ ম্যাচটা খুব কঠিন ছিল। তবে আসল খেলা তো এর পর। পদক পেতে গেলে ম্যাচটা জিততে হবে।’’ তাঁকে বলা হল, দ্বিতীয় গেমে ১৩-১৮ থেকে ওয়াং যখন ১৯-১৮ এগিয়ে যান, আপনাকে বেশ হতাশ মনে হচ্ছিল না? প্রশ্নটাকে শাট্লককের মতোই সপাটে উড়িয়ে দিয়ে হায়দরাবাদি মেয়ে হেসে বললেন, ‘‘এক মুহূর্তের জন্যও হতাশ হইনি। কোচ পাশে আছেন। তা ছাড়া আমি ম্যাচটা জিতবই, এই আত্মবিশ্বাস ছিল।’’ কঠিন ম্যাচে টার্নিং পয়েন্ট কী? সিন্ধুর উত্তর, ‘‘অপেক্ষা এবং অপেক্ষা। আর ধৈর্য না হারানো।’’
সিন্ধুকে কাল, বৃহস্পতিবার সেমিফাইনালে খেলতে হবে জাপানের নজোমি ওকুহারার বিরুদ্ধে। আপাতত ‘মিশন জাপান’ ধরেই এগোতে চান সিন্ধু আর তাঁর কোচ। ওই ম্যাচ জিতলে ফাইনালে সোনা-রুপোর লড়াইয়ে পৌঁছে যাবেন। হারলেও ব্রোঞ্জের সুযোগ থাকবে।
গোপী এ দিন বললেন, ‘‘চিনকে হারানোর জন্য আমাদের আলাদা স্ট্র্যাটেজি ছিল। সেটা কিছুটা কাজে লাগিয়েছে ও। এটা বলতেই হবে, আমার ছাত্রী তার অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, পদক না জিতলে ভাল পারফরম্যান্সের কোনও দাম নেই।’’ কোচের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল তাঁর আর এক ছাত্র কিদাম্বি শ্রীকান্তের ক্ষেত্রে। বিশ্বের তিন নম্বর এবং গত দুই অলিম্পিক্সের চ্যাম্পিয়ন, চিনের লিন ডানের সঙ্গে অসাধারণ লড়াই করেও ৬-২১, ২১-১১, ১৮-২১ হেরে গেলেন শ্রীকান্ত। জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ খেললেও কাজে এল না তাঁর লড়াই।
নিষ্ঠুর অলিম্পিক্স! চোখজুড়োনো পারফর্মারকেও সে তাড়িয়ে বেড়ায় সারা জীবন। একটা পদক না পাওয়ার অতৃপ্তিতে!