জুটি: প্রথম দিনের শেষে শাহবাজ (বাঁ-দিকে) ও অনুষ্টুপ। সিএবি মিডিয়া
মহানদীর তীর ধরে মাঠে যাওয়ার রাস্তায় ঘন কুয়াশা। এ পার থেকে ও পার দেখার কোনও প্রশ্নই নেই। নদী পেরোনোর সেতুও কুয়াশার আচ্ছাদনে ঢাকা।
মহানদীর সেই কুয়াশা পাড়ি দেয় বাংলার ড্রেসিংরুমে। বৃহস্পতিবার কোয়ার্টার ফাইনালে কটকের ড্রিমস ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস হেরে সবুজ পিচে ব্যাট করার পরীক্ষার মুখে পড়ে বাংলা। চার পেসারে দল সাজানো ওড়িশার বিরুদ্ধে ১৭তম ওভারের মধ্যেই উপরের সারির ব্যাটসম্যানেরা প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। পাঁচ উইকেট হারিয়ে বাংলার রান তখন ৪৬। দিনের শেষে ছয় উইকেট হারিয়ে বাংলার রান ৩০৮। ১৩৬ রানে অপরাজিত অনুষ্টুপ মজুমদার। ৮২ রানে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন শাহবাজ আহমেদ।
গত বার বাংলার ক্রিকেটের খবর যাঁরা নিয়মিত রেখেছেন, এই স্কোরবোর্ড কখনওই মেলাতে পারবেন না। অরুণ লালের প্রশিক্ষণে দলে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, প্রত্যেক মুহূর্তে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। একটি নাটকের মঞ্চে পরিণত হয়েছে এই বাংলা শিবির। যেখানে প্রত্যেক দিন স্টেজ দাপিয়ে যাচ্ছেন কোনও এক নতুন তারকা।
চলতি মরসুমের সেরা আবিষ্কার শাহবাজ আহমেদ। শেষ তিনটি ম্যাচে তিনিই নায়ক। কোনও দিন জ্বলে উঠছেন, আকাশ দীপ। কখনও আবার নীলকণ্ঠ দাস ও মুকেশ কুমার দলকে বিপন্মুক্ত করছেন। রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল সাক্ষী হয়ে থাকল আরও এক যোদ্ধার। তিনি অনুষ্টুপ। কোমর ভেঙে যাওয়া দলকে কী ভাবে স্বপ্নভঙ্গের আতঙ্ক থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, দেখিয়ে গেলেন তিনি। প্রত্যেক তরুণ ক্রিকেটারের কাছে উদাহরণ হয়ে থেকে গেল এই ইনিংস। মাঠে উপস্থিত প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা স্মৃতি উস্কেও মনে করতে পারলেন না, এ রকম ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাকে আগে দেখেছেন কি না। কোচ অরুণ লাল, স্পিন বোলিং উপদেষ্টা উৎপল চট্টোপাধ্যায়, বোলিং কোচ রণদেব বসুরা বলতে পারলেন না শেষ কবে এ রকম খেলেছে তাঁদের দল।
অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য বাংলার উপরের দিকের ব্যাটসম্যানেরা অনেকটাই দায়ী। ওড়িশার চার মিডিয়াম পেস বোলারের বিরুদ্ধে কেনই বা তাঁরা ব্যর্থ, ব্যাখ্যা করা কঠিন। অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরন (৭) যে ভঙ্গিতে আউট হয়েছেন, আগে কখনও তাঁর জীবনে ঘটেছে কি না সন্দেহ। লেগস্টাম্পের বাইরের বল গ্লান্স করতে গিয়ে উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান। বসন্ত মোহান্তির ভিতরের দিকে আসা বল কৌশিক ঘোষের (৯) ব্যাট ও প্যাডে লেগে চলে যায় স্লিপে। ছন্দহীন অভিষেক রামন সূর্যকান্ত প্রধানের বলে এলবিডব্লিউ হন। চার নম্বরে নামা অর্ণব নন্দী (২৪) উইকেটে থিতু হওয়ার পরে বাইরের বল কাট করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বসেন। এই পরিস্থিতিতে অনুষ্টুপ ও মনোজ তিওয়ারিই ছিলেন ভরসা। দেবব্রত প্রধানের প্রথম ওভারেই সব অঙ্ক পাল্টে যায়। তাঁর ইনসুইং প্যাডে আছড়ে পড়ে মনোজের (৪)। আঁধার নেমে আসে ড্রেসিংরুমে।
উইকেটে ঘাস থাকলেও বল অসম্ভব নড়াচড়া করছিল না। ১০০তম ম্যাচ খেলা বসন্তই কিছুটা সুইং পাচ্ছিলেন। যা আটকানোর জন্য ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যাট করেন অনুষ্টুপ। ব্যস, বাঘ পরিণত হয় বেড়ালে। বসন্তের সুইং ভাঙতে দেওয়ার আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন অনুষ্টুপ। এ ভাবেই ব্যাকফুটে ঠেলে দেন ওড়িশার পেসারদের।
শ্রীবৎস গোস্বামীর সঙ্গে খুচরো রান নিয়ে বিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করেন অনুষ্টুপ। ক্ষত মেরামত করে লাঞ্চে পাঁচ উইকেটে বাংলার স্কোর দাঁড়ায় ১১১।
বিরতির পরে সূর্যকান্ত প্রধানকে ফ্লিক করে চারটি রান কুড়িয়ে হাফসেঞ্চুরি পূরণ করেন অনুষ্টুপ। কিন্তু ৪২তম ওভারে আরও একটি ধাক্কা আসে বাংলা শিবিরে। ৩৪ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় শ্রীবৎসকে। ৯৫ রানের জুটি ভেঙে যায় সেখানেই।
ক্রিজে আসেন শাহবাজ। রাজস্থানের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৬১ রান করে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। পঞ্জাব ম্যাচে বল হাতে জ্বলে ওঠেন। সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই ওড়িশার বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামেন শাহবাজ। এক দিক থেকে খুচরো রান নিয়ে ইনিংস গড়েন অনুষ্টুপ। অন্য দিক থেকে বিপক্ষ বোলারদের উপর প্রতিআক্রমণ শুরু করেন শাহবাজ। বসন্ত, সূর্যকান্ত, প্রীত সিংহ চৌহনেরা খেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না কী ভাবে তাঁদের পরাস্ত করবেন? শেষমেশ পারেননি। ৬২তম ওভারে অফস্পিনার গোবিন্দ পোদ্দারকে সুইপ মেরে সেঞ্চুরি করেন অনুষ্টুপ। বাইরে থেকে কোচ অরুণ লাল চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘‘সাবাস অনুষ্টুপ, সারা দিন ব্যাট কর। শাহবাজকে বুঝিয়ে খেলে যা।’’ কিন্তু শাহবাজকে বোঝানোর কোনও প্রয়োজনই হয়নি। ক্যালকুলাস ভেদ করা বুদ্ধি তার মধ্যেই অঙ্ক কষে ফেলেছে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাংলাকে ফিরিয়ে আনার। মরসুমের শুরুতেই অরুণ লাল বলেছিলেন, ‘‘বোলারকে তুমি এক ঘণ্টা দাও, দিনের শেষে নায়ক হয়ে ফেরো।’’ সেই ফর্মুলা মেনে ফের সফল শাহবাজ। ১৬৭ রানের অপরাজিত জুটির দুই কান্ডারি এখন অপেক্ষায় বিপক্ষকে বড় রানের লক্ষ্য দেওয়ার। যা খুব একটা অসম্ভব নয়। প্রাণ হারানো উইকেট এখন ব্যাটসম্যান সহায়ক। বিপক্ষ বোলারদের জুজুও ধরে ফেলা গিয়েছে।
কিন্তু দিনের শেষে শ্রীবৎসের আউট নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেল। নিজের আউট নিয়ে প্রসন্ন নন শ্রীবৎস। প্রীত সিংহের কট বিহাইন্ডের আবেদনের প্রতিবাদে থাইপ্যাড ইঙ্গিত করে শ্রীবৎস বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি আউট নন। এই ভঙ্গির জন্য দিনের শেষে ম্যাচ রেফারি ডেকে পাঠান তাঁকে।