রাকেশ হাজোয়ারি ও পবিত্র ক্ষত্রীয়।
দুই যুবককে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে জেলে পাঠালেও অস্ট্রেলিয়ার টিম বাসে পাথর ছোঁড়ার ঘটনায় মুখ বাঁচাতে পারছে না পুলিশ ও অসম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। এক দিকে ধৃতদের পরিবার দাবি করেছে গ্রেফতার হওয়া রাকেশ হাজোয়ারি (২৫) ও পবিত্র ক্ষত্রীয় (১৮) মোটেই সেদিন খেলা দেখতে যাননি বা বাসে পাথর ছোঁড়েননি। তাঁরা একটি বিস্কুট সংস্থায় ট্রাক চালান। বাড়ি ফেরার জন্য জাতীয় সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পুলিশ তাঁদের থানায় তুলে এনে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে। অন্য দিকে গুয়াহাটির পরিবহণ সংস্থাগুলির দাবি, আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের আনা-নেওয়া করার জন্য সবসময় ভলভো বাস ব্যবহার করা হয়, যে বাসের কাচ শক্ত ও ল্যামিনেটেড হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার টিম বাস হিসেবে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ এসি বাস। তাই বাইরে থেকে ছোঁড়া পাথর কাচের বিরাট অংশ চুরমার করে বাসের মধ্যে এসে পড়ে।
আরও পড়ুন:
অস্ট্রেলিয়া টিম বাসে পাথর, ঘটনাকে লঘু করতে ব্যস্ত পুলিশ-প্রশাসন
ভারতীয় ক্রিকেটারদের রেস্তোরাঁ সম্পর্কে জেনে নিন
পাথর ছোঁড়ার ঘটনায় প্রথম থেকেই নিরাপত্তার ফাঁক নেই বলে দাবি করে এসেছেন পুলিশ কমিশনার হীরেন নাথ। দাবি করেন পাঁচটি পুলিশের গাড়ি বাসকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল। কিন্তু পাথর ছোঁড়ার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কোনও পুলিশের গাড়িই, কে বা কারা পাথর ছুঁড়ল- তাদের সন্ধানে ধাওয়া করেনি। বরং পরে দুই যুবককে গ্রেফতার করে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে জেলে পাঠানো হয়। গড়চুক পুলিশ ওই দুই যুবককে গ্রেফতার করলেও, প্রথম সেখানকার ওসি জানিয়েছিলেন ধৃতদের ‘অন্য কেস’-এ ধরা হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ভাষ্য বদলে যায়। ধৃতদের বিরুদ্ধে ৩০৭ ধারায় খুনের চেষ্টা, ৩৩৬ ধারায় জীবন বিপন্নকারী কাজ করা, ৪২৭ ধারায় দুষ্কার্যের ফলে ক্ষতি ও ৫১১ ধারায় মামলা রুজু করে আদালতে তোলা হয়। আদালত গত কাল দু’জনকে ১৪ দিনের জেল হাজতেও পাঠায়।
কিন্তু রাকেশ ও পবিত্র যে ট্রাকের চালক ও সহকারী, সেই ট্রাকের মালিক প্রদীপকুমার দাস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই দিন রাকেশরা ট্রাক নিয়ে রহা গিয়েছিল। ফেরার পথে, খেলার জন্য সন্ধ্যায় জোড়াবাটে পুলিশ ট্রাক ঢুকতে দেয়নি। খেলা শেষে রাতে তাঁরা লখরায় ফিরে এসে ট্রাক গ্যারেজে রাখে। রাকেশ জানায় বাড়িতে পুজো থাকায় রাতেই তারা ধূপধারায় যেতে চায়। সেই মতো কোনও ট্রাকে উঠে ধূপধারা যাবে বলেই তারা বাইপাসে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রদীপবাবু জানান, সেই সময়ই জিপে আসা পুলিশের একটি দল রাকেশ ও পবিত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে জিপে তোলে। কিন্তু তাঁদের সোজা গড়চুক থানায় নিয়ে গিয়ে কাগজে সই করানো হয়। তারপর পোরা হয় হাজতে। ট্রাক মালিকের দাবি, ট্রাক গ্যারেজে ঢোকানোর ছবি তাঁর সিসি ক্যামেরায় রয়েছে। পাথরকাণ্ডে রাকেশ-পবিত্রর কোনও ভূমিকা নেই। ধূপধারার মাউরিয়াপাড়ার বাসিন্দা হাজোয়ারি ও সুতারপাড়ার বাসিন্দা ক্ষত্রীয় পরিবারও দাবি করেছে, মিথ্যেই দুই দরিদ্র যুবককে ওই ঘটনায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে পুলিশ। পবিত্র মাত্র এক সপ্তাহ আগে গুয়াহাটি এসেছিল কাজের সন্ধানে।
পুলিশ অবশ্য দাবি করছে, সন্দেহজনক আচরণ ও বক্তব্যে অসঙ্গতির জন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু বক্তব্য অসঙ্গতি থাকলেই বিনা প্রমাণে এত বড় কাণ্ডে জড়িয়ে দুই যুবককে জেলে পাঠানো যায়! কমিশনার জানান, নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই তাদের ধরা হয়েছে। তদন্ত চলছে। এর বেশি বলা যাবে না। যুগ্ম কমিশনার দিগন্ত বরা জানান তদন্ত রিপোর্ট এক সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হবে।
এ দিকে পাথর ছোঁড়ার ফলে যে ভাবে বাসের কাচের অনেকটা অংশ গুঁড়ো হয় ভিতরের আসনে এসে পড়েছে- তাতে ওই বাস আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের টিম বাস হওয়ার উপযুক্ত ছিল কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়, বাসের কাচের নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। মিলেছে পাথরের খণ্ডও। কাচ আদৌ ‘টাফেন্ড গ্লাস’ বা ‘ল্যামিনেটেড’ ছিল না। পরিবহণ সংস্থাগুলির বক্তব্য, দেশ বা বিদেশের দলের টিম বাস হিসেবে সবসময় ভলভো কাঠামোর বাস নেওয়া হয়। ফিফা অনুর্ধ-১৭ দলগুলির জন্যেও তেমন বাসই ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক বৈশিষ্ট্য থাকার পাশাপাশি ওই বাসের কাচে দুটি স্তরের মধ্যবর্তী অংশে ভিনাইলের পরত থাকে। ফলে বাইরের আঘাতে কাচ গুড়ো হয়ে বাসের ভিতরে পড়ে না। এতখানি অংশও গুঁড়ো হয় না। ভলভো বাসে দুটি জরুরি দরজাও থাকে। কিন্তু এসিএ যে বাসের ব্যবস্থা করেছিল- তা একেবারেই এএসটিসির এসি বাস ছিল। দলের জন্য কোনও বিকল্প বাসও ছিল না। কাচ ভাঙার পরের দিন ভোরেই তা সারাই করে ফেল অস্ট্রেলিয়ার দলকে বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। বাস বাছাইয়ে গলদ অবশ্য মানতে নারাজ এসিএ। তাদের বক্তব্য বিভিন্ন বিষয় যাচাই করেই বাস নেওয়া হয়েছিল। বাসে পাথর মারার ঘটনা কাশ্মীরে ঘটে, অসমে ঘটে না। তাই শক্ত কাচের উপরে তেমন জোর দেওয়া হয়নি!
অবশ্য বাস কাণ্ডে জটিলতা ও তদন্তে অসঙ্গতির মধ্যেও অসমবাসীর পক্ষে ভাল খবর, বিসিসিআই পাথর ছোঁড়ার ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখছে এবং অসম পুলিশ দ্রুত দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার ঘটনার উল্লেখ করে আইসিসিকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে। বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের পরেই গুয়াহাটির খেলা নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বিসিসিআই সূত্রে খবর, এসিএর ব্যবস্থাপনা ও পুলিশ-প্রশাসনের নিরাপত্তার খামতির কথা রিপোর্টে লেখা হবে না। ঘটনার পরদিন হোটেল ও বিমানবন্দরের সামনে গুয়াহাটির মানুষ যে ভাবে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে দলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন- তা দেখে অভিভূত অস্ট্রেলিয়া দলও। দলের সদস্য মসেস হেনরিকস টুইটে লেখেন, রাতে বাসের ঘটনাটা আদর্শ ছিল না, কিন্তু তার প্রতিবাদে অসমের চারদিক থেকে বাচ্চা ও সমর্খকদের যে ভালবাসা দেখা গেল তা খুবই উৎসাহের।