বাঙালি ফুটবল ভুলে শুধু ক্রিকেটে মজেছে মানা যায় না। ঢাকা-কলকাতার ক্রিকেট দাপটে ফুটবল মুখ লুকিয়েছে এমনটাও নয়। ফুটবলের টানটা যেমন ছিল তেমনই আছে। নইলে রাত জেগে বিশ্বকাপ, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল দেখে কেন। মেসি-রোনাল্ডোকে নিয়ে তরজা কোন কারণে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জয় পরাজয়ে নিজেদের জড়ায় কোন আবেগে। একমাত্র রাগে, দুঃখে, অভিমানে জ্বলে ওঠে ঘরের ফুটবলের কথা ভেবে। শূন্য আকাশে তারা খোঁজার ক্লান্তি। মন নাড়া দেয় অতীত দৃষ্টান্তে। মান রাখে না বর্তমান। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ান জুলফিকার হায়দার। পড়াতে পড়াতে মন ছুটে যায় ফুটবল মাঠে। টান এমনই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে ফুটবলকে টেনে তোলার প্রাণপণ প্রয়াস। কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়ে না। আপন মনে বলেই ফেলেন, 'আমাগো দ্যাশের ফুটবলের হাল এহেন কেমন জানেন, ওই একখান কথা আছিল না, না আছে রাজা না আছে রাজ্যপাট। অনেকটা ওইরকম। বর্তমান বইল্যা কিছুই নাই। পুরাডাই অতীত আঁকড়াইয়্যা বাঁইচ্যা থাকোনের চেষ্টা।' তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে কলকাতা ফুটবলের সঙ্গেও। বিদেশি ফুটবলারের এজেন্ট হিসেবে ইস্টবেঙ্গলকে এনে দিয়েছেন হাইতির ওয়েডসনকে।
আরও পড়ুন: ‘মারিনকে হারিয়ে সিন্ধু উট থেকে জিরাফ হল’
১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পরেও ঢাকার ফুটবল দেখে চমকাত করাচি, রাওয়ালপিন্ডি। ঢাকা ওয়ান্ডারর্স, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা দেখতে ভিড় উপচে পড়ত মাঠে। ১৯৪৮-এ ঢাকা লিগ জেতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং। একাত্তরে মুক্তির এক বছর পর ১৯৭২-এ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৩-এ মালয়েশিয়ায় মারডেকা স্টেডিয়ামে তাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রতিপক্ষকে কাঁদিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭৪-এ চাগিয়ে ওঠে ফিফার সদস্য পদ পেয়ে। বারবার উড়িয়ে দিতে থাকে ভারত, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াকে। বাংলাদেশ ফুটবল দল তখন বিভীষিকা। ইরান পর্যন্ত নাস্তানাবুদ হয়েছে। সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো পা সাবির, গোলাম গাওস, শেখ আসলাম, তাইসার হামিদ, বাদল রায়, আশিস ভদ্র, খুরশিদ বাবুলদের। বাংলাদেশের স্বর্ণযুগের ফুটবল রত্ন কাজি সালাউদ্দিন এখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। তিনিও জানেন, চারা না পুঁতেই ফলের আশা বৃথা। একটা ফুটবল একাডেমি নেই বাংলাদেশে। দেশের সর্বত্র ক্রিকেট শিবির। অহরহ ক্রিকেট তারকা সরবরাহ করছে।
এক সময় কলকাতা ময়দানও কাঁপিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। রক্সি, সাব্বির, মুন্না, রুমি, শেখ আসলামকে ভোলেনি পশ্চিমবঙ্গ। এখনকার নায়ক আতিকুর রহমান মেসু, রইহান হাসান, মামানুল ইসলাম, জাহিদ হাসান আলামির কদর নেই স্বদেশেই। বিদেশি ফুটবলারদের ভরসায় বাংলাদেশ। প্রধান দুটো ফুটবল প্রতিযোগিতা বাংলাদেশ ফুটবল প্রিমিয়ার লিগ আর ফেডারেশন কাপে বিদেশি খেলোয়াড়দের ভিড় । তাঁরাও খেলে খুশি নয়। দর্শক না থাকায় মনমরা। সোনি নর্ডি দু'বছর আগেই ঢাকা ছেড়ে কলকাতায়। এ বার তাঁকে অনুসরণ করেছেন ওয়েডসন। মলদ্বীপের কাছে পাঁচ গোল খেয়েছে বাংলাদেশ। ভুটানের মতো দুর্বল দলও গুনে গুনে তিন গোল দিয়েছে। এই পরাজয় প্রত্যাশিত না। ক্রিকেটে যখন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজুর রহমান, মাশরাফি মোর্তাজা, সৌম্য সরকার, মেহেদি হাসান মিরাজের মতো তারকারা দুনিয়া দাপাচ্ছেন, ফুটবলের পালে হাওয়া থাকবে না কেন। কলকাতার অবস্থাটাও একই রকম। বিদেশি প্লেয়ারদের দিয়ে ফাঁক ভরাটের চেষ্টা। সেটা কত দিন। বাঙালির ফুটবল কি তিলে তিলে মরবে, না নতুন উদ্দীপনায় জাগবে। পরিকাঠামো তৈরি করলেই পরিস্থিতি পাল্টাবে। ফুটবল মাঠে ভিড় জমবে। তারকায় ছেয়ে যাবে ফুটবল প্রাঙ্গন। বাঙালি ফুটবল নতুন করে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করতে পারবে তবেই।