ঋষভের জন্য জাতীয় দলের দরজা এই মুহূর্তে বন্ধ দেখাচ্ছে।
দিকভ্রষ্ট প্রতিভা? নাকি ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসা তারকা? ভারতীয় ক্রিকেটে ঋষভ পন্থ ক্রমশ যেন এক ধাঁধা হয়ে উঠছেন!
২২ বছরের জীবনে ২২ গজের রকমারি দিক দেখে ফেলেছেন তিনি। প্রশংসা-বিদ্রুপ-সাফল্য-ব্যর্থতা-উচ্ছ্বাস-হতাশা। জীবনের নানা দিক, চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী তিনি। জীবন কখনও শিখরে পৌঁছে দিয়েছে, আবার পর ক্ষণেই আছড়ে ফেলেছে রুক্ষ কঠোর জমিতে। সামনে কী, এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। যার উত্তর সম্ভবত ঋষভ পন্থের কাছেও নেই!
একসময় তিন ফরম্যাটেই প্রথম এগারোয় নিশ্চিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। চিহ্নিত হচ্ছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে। অদ্ভুত হল, এই মুহূর্তে কোনও ফরম্যাটেই নিশ্চিত নন তিনি। কয়েক মাস পরেই অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাৎপর্যের হল, যে ঘরানায় তাঁকে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও এখন এগারোয় জায়গা হচ্ছে না তাঁর!
আরও পড়ুন: দাপটের সঙ্গে জিতলেও যে বিষয়গুলো চিন্তায় রাখবে বিরাটের ভারতকে
একটু পিছনে যাওয়া যাক। ২০১৮ সালের অগস্টে ইংল্যান্ডে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল দিল্লির এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের। ঋদ্ধিমান সাহার চোট দীনেশ কার্তিকের সামনে টেস্টের দরজা খুলে দিয়েছিল। আর কার্তিক প্রথম দুই টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় শিকে ছিড়েছিল পন্থের। যদিও স্কোয়াডে দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে ছিলেন কেএস ভরত। কিন্তু, ভরত নন, ব্যাটিংয়ের হাত ভাল হওয়ায় সুবাদে অভিষেক ঘটল ঋষভের। টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে উঠলেন তিনি। টেস্টে তাঁর প্রথম স্কোরিং শটই ছিল সাড়াজাগানো ছয়। যেন ঘোষণা করেছিলেন আবির্ভাবের। ওভালে, সিরিজের শেষ টেস্টে প্রথম ভারতীয় উইকেটকিপার হিসেবে ইংল্যান্ডে টেস্ট সেঞ্চুরিও করলেন। যে ইনিংস টেস্টে তাঁর জায়গা পাকাপাকি করে তুলল। যদিও কিপার পন্থকে নিয়ে সংশয় থেকেই গেল। দুই টেস্টেই যে দিয়েছিলেন ৭০ বাই!
২০১৯ সালের গোড়ায় অস্ট্রেলিয়া সফরেও টেস্টে এল সেঞ্চুরি। সিডনিতে অপরাজিত থাকলেন ১৫৯ রানে। কোনও ভারতীয় উইকেটকিপারের ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় টেস্টে শতরান নেই। ঋষভই হলেন ভারতীয় কিপারদের জগতে এই কীর্তিতে প্রথম পুরুষ। এই সফরে শুধু ব্যাটই কথা হলেনি, ঋষভের মুখও কথা বলেছিল লাগাতার। জবাবে পেলেন অজি অধিনায়ক টিম পেনের দেওয়া ‘বেবিসিটার’ তকমা। যদিও স্লেজিং, কথা-কাটাকাটির দুনিয়াকে পিছনে ফেলে পেনের সন্তানকে কোলে নিয়ে সত্যিকারের ‘বেবিসিটার’ হয়ে উঠেছিলেন পন্থ!
এর পর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজ। যেখানে গ্যালারি থেকে ‘ধোনি ধোনি’ আওয়াজ শুনতে হল একটানা। বিদ্রুপের সঙ্গে সেই পরিচয়। যা চলছে এখনও। ভারতীয় দলের মিডল অর্ডারে ব্যাটিং খুব সহজও ছিল না। হয়, ইনিংস মেরামতের কাজ, নয়তো শুরু থেকেই চালানো।
ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে ছিলেন না গোড়ায়। কিন্তু শিখর ধওয়নের চোট এনে দিল সুযোগ। লিগ পর্যায়ে তেমন দরকার পড়েনি। কিন্তু সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতিতে ম্যাচ জেতানোর দায়িত্ব পড়ল ঘাড়ে। পরিত্রাতা হলেই নিশ্চিত নায়ক হতেন। কিন্তু পারলেন না। এক ঘন্টারও বেশি সময় ক্রিজে থেকে চালালেন লড়াই। কিন্তু তার পর সংযম হারিয়ে বিপক্ষের স্পিনারকে মারতে গিয়ে দিলেন ক্যাচ। ড্রেসিংরুমে সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ধরল উত্তেজিত অধিনায়ক বিরাট কোহালিকে। ধরা পড়ল শুধু ক্রিকেটপ্রেমীরাই নন, ড্রেসিংরুমেও চলছে পন্থের মুণ্ডপাত।
ধোনির ছুটি ক্রমশ লম্বা হতে থাকায় বিশ্বকাপের পর লাগাতার খেলে যেতে থাকলেন ঋষভ। কিন্তু ধারাবাহিক হতে পারলেন না। বরং ক্রমশ বাড়তে লাগল বিদ্রুপের পরিমাণ। শুনতে হল ধোনির জয়ধ্বনি। স্টাম্পের সামনে হাত বাড়িয়ে বল ধরার ঘটনাও ঘটল। অধিনায়ক বিরাট কোহালি ও সহ-অধিনায়ক রোহিত শর্মা একসময় আবেদন জানাতে বাধ্য হলেন ক্রিকেটপ্রেমীদের উদ্দেশে যে, রেহাই দিন ঋষভকে, থাকতে দিন নিজের মতো!
এর মধ্যে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট দল থেকে বাদ পড়লেন তিনি। ঋদ্ধিমান সাহার উন্নতমানের কিপিং চোখে আঙুল দিয়ে যেন তফাতটা দেখিয়ে দিল। টেস্ট কিপিংয়ে কতটা পিছিয়ে, দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হল তা। ঋষভ ফিরে গেলেন শুরুর দিনগুলোয়। কোচ তারক সিন্হার তত্ত্বাবধানে আলাদা খাটাখাটনিও করলেন। ছোট ফরম্যাটে রানও পেলেন। কিন্তু দলের ভরসা হয়ে উঠতে পারলেন না। দুঃসময়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার অভিযোগকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলতে পারলেন না।
নতুন বছরের গোড়ায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে একদিনের সিরিজে পরিস্থিতি আরও খারাপ হল। মুম্বইয়ে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে মাথায় চোট পেলেন ঋষভ। কনকাসন হল তাঁর। লোকেশ রাহুলকে কিপিং করতে হল বাধ্য হয়ে। চর্চা শুরু হল, দেশেই বাউন্সারে মাথায় লাগা মানে তো ব্যাটিংয়ের টেকনিকও গিয়েছে!
রাজকোটে পরের ম্যাচে কিপার হিসেবেই খেললেন লোকেশ রাহুল। কিপার হিসেবে ভরসা তো দিলেনই। ব্যাট হাতেও পাঁচ নম্বরে নেমে ৫২ বলে করলেন বিস্ফোরক ৮০। হলেন ম্যাচের সেরা। উইকেটকিপার ও ব্যাটসম্যান, দুই ভূমিকাতেই ঋষভের জায়গা কার্যত দখল করে নিলেন রাহুল।
নিউজিল্যান্ড সফরে শিখর ধওয়ন চোটের জন্য যেতে না পারলেও পাল্টাল না পরিস্থিতি। একটা জায়গা ফাঁকা ঠিকই হল মিডল অর্ডারে। কিন্তু, টি-টোয়েন্টি সিরিজে সেই জায়গায় বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে মণীশ পাণ্ডের উপর আস্থা রাখল টিম ম্যানেজমেন্ট। কিপার রাহুলের পক্ষে সওয়াল করলেন বিরাটও। ক্লাস ফাইভের ক্রিকেটশিক্ষার্থীর কাছেও স্পষ্ট হল যে, কিপার হিসেবে রাহুলকেই খেলাতে চাইছে দল।
এই মুহূর্তে ঋষভ অস্তিত্বের সঙ্কটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর পরের ম্যাচ যে কবে হতে পারে, তা কারও জানা নেই। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার ও প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “সেভেনের ছাত্রকে নাইন-টেনের অঙ্ক কষতে দিলে যা হয়, তাই হয়েছে ঋষভের। ওর উচিত অবিলম্বে দেশে ফিরে এসে রঞ্জি ট্রফি খেলা। আর ভারতের বিশ্বকাপের দলে চার নম্বরে শ্রেয়াস নিশ্চিত। ব্যাটসম্যান ও ফিল্ডিংয়ের জন্য মণীশ পাণ্ডেকেও সবসময় খেলানো উচিত। আর রাহুল তো মেকশিফট কিপার হিসেবে একেবারেই ঠিকঠাক। এই ফরম্যাটে বড় জোর ১০টা বল ধরতে হয় কিপারকে। কিপারের কাজ হল দৌড়ে স্টাম্প পর্যন্ত আসা। রান-আউটের সুযোগ নেওয়া। এগুলো দক্ষতার সঙ্গে ও করছে। আর স্টাম্পিংয়ের সুযোগ থাকছে কুলদীপ বা চহালের বলে। না ঘুরলে জাডেজার বলে স্টাম্পিং সম্ভব না। ও সেটাও করছে। পাশাপাশি, স্টেপনি হিসেবে ব্যাটিং অর্ডারে এক থেকে পাঁচ, সর্বত্র নামানো যায়। বিশ্বকাপের আগে এই সিরিজে পর খুব বেশি টি-টোয়েন্টি বাকি নেই। তাই ঋষভকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতেই হবে ভারতকে। যেটা আগেই বলা উচিত ছিল।”
ঋষভের জন্য বিসর্জনের বাজনা শুনতে পাচ্ছেন দেশের আর এক প্রাক্তন উইকেটকিপার সদানন্দ বিশ্বনাথও। ভারতীয় ক্রিকেটে যিনি নিজেও নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রতিভা হিসেবেই পরিচিত। সে জন্যই সমব্যথী তিনি। ঋষভের জন্য তাঁর পরামর্শ, “হাল ছাড়লে চলবে না। কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে ঋষভকে। ধৈর্য ধরতে হবে।”
আরও পড়ুন: বোলিং বিভাগ মেরামতে কাল কি দলে বদল? দেখে নিন অকল্যান্ডে ভারতের সম্ভাব্য একাদশ
প্রতীকী নয়, এটাই যেন বাস্তব ছবি।
টিম ম্যানেজমেন্টের যদিও দোষ দেখছেন না তিনি। কারণ, দলের ভারসাম্যেই জোর দেওয়া হয়েছে। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুল তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য। আর বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবেও মণীশই পাচ্ছেন দলের ভোট। সদানন্দ বিশ্বনাথের কথায়, “রাহুল অসম্ভব প্রতিভাবান। আর মণীশ টি-টোয়েন্টিতে মিডল অর্ডারে নিয়ে ফেলেছে ঋষভের জায়গা। বিরাট কোহালি বরং পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটে খেলাতে পারে ঋষভকে। কারণ, রাহুলকে দিয়ে একদিনের ম্যাচেও কিপিং করানো বড্ড বেশি চাপ দেওয়া হবে। রানও করবে, কিপিও করবে, এতটা আশা না করাই ভাল। তা ছাড়া চোটও পেয়ে যেতে পারে তো। তাই ওয়ানডে ক্রিকেটে আমি ঋষভকে কিপার হিসেবে দেখতে চাইছি। তবে এটা পুরোটাই নির্ভর করছে রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহালির ভাবনাচিন্তার উপর।”
গুরুত্বপূর্ণ হল, টিম ম্যানেজমেন্টের ভাবনা কোন সরণিতে ছুটছে, তার ইঙ্গিত মিলেও গিয়েছে। সেই সরণিতে পন্থের জন্য কোনও স্বস্তির স্টেশন অন্তত এই মুহূর্তে নেই। বরং সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের সওয়ারিই দেখাচ্ছে তাঁকে। যার দায় আবার পুরোপুরি তাঁরই!
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ