প্রয়াত: চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকের ছায়া। ফাইল চিত্র
চিন্ময় আমার ভাই, বন্ধু ও সতীর্থ! দু’জনের বাড়ি যেমন খড়দহে, তেমনই ফুটবলার হিসেবে উত্থান রহড়া সঙ্ঘ থেকে। একসঙ্গেই খড়দহ থেকে কলকাতা ময়দানে যাতায়াত করতাম। বাইরেও খেলতে যেতাম।
চিন্ময়ের চেয়ে বয়সে আমি বছর চারেকের বড়। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল একেবারে বন্ধুর মতো। ভাবতেই পারছি না, ওর মতো শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ এ ভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যাবে। অথচ বড় কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না ওর। গত কয়েক বছর ধরে কানে একটু কম শুনত শুধু।
আমার আদর্শ ছিলেন কিংবদন্তি পরিমল দে। আর আমাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল চিন্ময়। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা ফুটবলে রহড়া সঙ্ঘের হয়ে আমি, চিন্ময় ও ভাস্কর (গঙ্গোপাধ্যায়)একসঙ্গে খেলতাম। ও ছিল ফুটবলের একনিষ্ঠ সাধক। কখনও গা ছাড়া মনোভাব দেখিনি। খেলার সূত্রে আমি অনেক আগেই চাকরি পেয়েছিলাম। চিন্ময় তখনও পায়নি। দুপুরবেলা ও একটা বল নিয়ে এসে আমাকে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠে টেনে নিয়ে যেত অনুশীলনের জন্য। আমি বল নিয়ে উঠতাম, ও ট্যাকল করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন চলত। চিন্ময়ের ফুটবলবোধ ছিল অবিশ্বাস্য। সাইডব্যাক ও স্টপার, দু’টি পজিশনেই খেলত।
ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে হিসেবে পরিচিত হলেও চিন্ময় প্রথমে সই করেছিল মোহনবাগানে। প্রথম বছর সে ভাবে খেলার সুযোগ না পাওয়ায় ১৯৭৬ সালে লাল-হলুদে যোগ দেয়। সেই সময় আমিও ইস্টবেঙ্গলে। সে বছর দুর্ধর্ষ দল ছিল আমাদের। সুধীর কর্মকার থাকায় প্রথম দিকে খেলার সুযোগ খুব একটা পাচ্ছিল না। ১৯৭৬ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালের ঠিক আগে পেটের সমস্যায় অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায় দল থেকে ছিটকে যায়। কোচ অমল দত্তকে সুধীরদা বলেছিলেন, “আমি স্টপারে খেলব। চিন্ময়কে রাইটব্যাক পজিশনে খেলান। ওর মতো অসাধারণ ডিফেন্ডার আমি খুব কম দেখেছি।” সেই ম্যাচে অবিশ্বাস্য খেলেছিল চিন্ময়। তার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮১ সালে মহমেডানের কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যেও অন্যতম কারিগর ছিল চিন্ময়। এক সমর্থক তো ওকে নিজের হাত থেকে ঘড়ি খুলে উপহার দিয়েছিলেন মাঠের মধ্যেই।
রক্ষণে খেললেও চিন্ময়ের ট্যাকল অসাধারণ ছিল না। কিন্তু প্রখর ফুটবলবোধ দিয়ে সেই অভাব পূরণ করেছিল। ১৯৭৬ সালে পটনায় সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা বনাম পঞ্জাব ম্যাচ। রাইটব্যাকে দিলীপ সরকার থাকায় স্টপারে সুব্রত ভট্টাচার্যের সঙ্গে খেলেছিল চিন্ময়। ও একাই কার্যত থামিয়ে দিয়েছিল পঞ্জাবের যাবতীয় আক্রমণ। চিন্ময়ের আরও একটা বিশেষ ক্ষমতা হচ্ছে, গোল করানো। প্রান্ত থেকে বল নিয়ে উঠে বিপক্ষের বক্সে সেন্টার করে অসংখ্য গোল করিয়েছে। দ্রুত নেমে আসত রক্ষণে।
চিন্ময় ছিল অসম্ভব সংযমী। আমি হয়তো অনেক সময় কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশি খেয়ে ফেলতাম। ওকে কোনও দিন তা করতে দেখিনি। রাত ন’টার পরে কখনও জেগে থাকত না। শনিবারও তাই করেছিল।
সারা জীবন অসাধারণ খেলা সত্ত্বেও চিন্ময় কখনও ভুলতে পারেনি ১৯৭৯ সালে কলকাতা লিগে সেই ব্যাকপাস থেকে মোহনবাগানের মানস ভট্টাচার্যের গোল করার ঘটনা। ম্যাচের পরে লাল-হলুদ সমর্থকদের ব্যবহারে খুব কষ্ট পেয়েছিল। সে বছর কোনও ট্রফি জিততে না পারার জন্য সমর্থকেরা ওকেই কাঠগড়ায় তোলেন। ব্যাকপাস নিয়ে বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে আজীবন।
আমি কিন্তু চিন্ময়কে দায়ী করতে রাজি নই। সে বছর আমি ছিলাম মোহনবাগানে। কোচ ছিলেন প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়)। চোট সারিয়ে দীর্ঘ দিন পরে সেই ম্যাচে আমিও মাঠে নেমেছি। প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গল কার্যত আমাদের দাঁড়াতেই দেয়নি। চিন্ময় বল ধরতেই মানস তাড়া করেছিল। ও তাড়াহুড়ো করে ভাস্করকে ব্যাকপাস করে। মানস বলটা ধরে গোলে ঠেলে দেয়। আমার মনে হয়, বলের গতি কম ছিল বলেই মানস ধরতে পেরেছিল।
ম্যাচের পরে একসঙ্গে খড়দহ ফিরেছিলাম। দেখেছিলাম, পাড়া জুড়ে চিন্ময়ের নামে পোস্টার। এমনকি, ওর বাড়ির দেওয়ালেও পোস্টার। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে সেই অভিমান নিয়েই চলে গেল চিন্ময়।