ইতিহাসের এক মাস পরে: মঙ্গলবার ভোর ভোর এবং সকালের হাড়ভাঙা প্র্যাকটিস সেশনের পর গোপীচন্দ অ্যাকাডেমির কোর্টের বাইরে পিভি সিন্ধু।
সেই ভদ্রলোক আজ অ্যাকাডেমিতে এসেছেন। রিও যাওয়ার আগে যিনি ভাইঝি-সম পিভি সিন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘বিএমডব্লিউর কোন কালারটা তোমার পছন্দ?’’
সিন্ধু শিউরে উঠে বলেছিলেন, ‘‘স্যর এখন এ সব কথাই তুলবেন না। আগে রিও থেকে পদক আনি। তার পর বিএমডব্লিউ।’’
হায়দরাবাদ ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সেই চামুণ্ডেশ্বরনাথের দিকে এ দিন সকালে তাকিয়ে সিন্ধু বলছিলেন, ‘‘রংটা আমাকে চুজ করতে হয়নি। সচিনই করে দেন— লাল।’’
পুসরলা বেঙ্কট সিন্ধুর অলিম্পিক্স রুপোজয়ের এক মাস পূর্তি হল মঙ্গলবার। আসলে এক মাস পেরিয়ে এক দিনে পড়ল। তাঁর পদক-ছুটি যেন শেষ হয়ে নতুন সেশন শুরু হল এ দিন। অলিম্পিক্সের আগে যেমন ভোর সাড়ে চারটেয় অ্যাকাডেমির কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করতেন, মঙ্গলবারও তাই। দু’ঘণ্টা খেলে একটা ব্রেক। তার পর ভোর শেষ হয়ে আবার সকালের সেশন শুরু। এই দুই সেশন শেষ করে আনন্দবাজারের সামনে এক্সক্লুসিভ বসলেন সিন্ধু। বললেন, ‘‘আবার রুটিনে ফেরত এলাম। কোচ বলেই দিয়েছিলেন অবশ্য আস্তে আস্তে এ বার পরিচিত জীবনে ফেরো।’’
সিন্ধুর ‘অপরিচিত’ জীবন কী? না, নিজের মোবাইল নিজের কাছে রাখতে পারা। আইসক্রিম খেতে পারা। মাঝেমধ্যে হায়দরাবাদি বিরিয়ানির স্বাদ উপভোগ করা। বিভিন্ন সংবর্ধনায় যাওয়া। আর সময় পেলে এক-আধটা সিনেমা দেখে নেওয়া। যেমন দেখেছিলেন ‘সুলতান’। ওটাই শেষ হিন্দি ছবি দেখা।
২০ অগস্ট-১৯ সেপ্টেম্বর, পদক-উৎসবের এই যে এক মাস গেল, তার মধ্যে এনটিআর অভিনীত তেলুগু ফিল্ম দেখেছেন সিন্ধু। কিন্তু ‘পিঙ্ক’ দেখা হয়ে ওঠেনি। ‘‘ওরা চাইছিল শুক্রবার একটু বেশি রাতের শো-তে যাই। কিন্তু অত রাত্তির জাগি না বলে যেতে পারিনি।’’ একে তো ‘পিঙ্ক’ মহিলাদের ছবি। তার ওপর প্রধান অভিনেত্রী তাপসী পান্নু তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু। মঙ্গলবার সিন্ধুকে দেখে অবশ্য মনে হল, এই যে ঘর্মাক্তকরণ রুটিনের মধ্যে ফের ঢুকে গেলেন, তার মধ্যে থেকে ‘পিঙ্ক’-এর জন্য সময় বের করা সহজ হবে না।
অ্যাকাডেমির যে অফিস ঘরটায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, তার থেকে দশ গজ দূরে একটা বড় কাচের ঘর। যার ভিতর বসে আছেন সিন্ধুর ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড পুল্লেলা গোপীচন্দ। কলকাতার নানান বড় পুজো উদ্বোধনের জন্য সিন্ধুকে বিশেষ ভাবে চায় শুনে গোপীচন্দ বললেন, ‘‘প্রচুর খাটাখাটনির পর সেলিব্রেশনের জন্য একটা সময় দেওয়া দরকার ছিল। সেই সময়টা অনেকটাই দেওয়া হয়েছে সংবর্ধনা-জাতীয় নানা অনুষ্ঠানে। এ বার আবার ব্যালান্স করতে হবে। অক্টোবরে সিন্ধুর বড় টুর্নামেন্ট।’’
বাড়িতে ট্রফি ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে মা পি বিজয়া। যিনি নিজে এক সময় ভলিবলার ছিলেন।
ডেনমার্কে সেই ব্যাডমিন্টন সুপার সিরিজ চলবে ২২-২৮ অক্টোবর। এ দিন সিন্ধুকে দেখে মনে হচ্ছিল, সংবর্ধনা-বিএমডব্লিউ-তেন্ডুলকর-নিজের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পিঠ চাপড়ানি, সব পিছনে ফেলে আবার শাটল কক-কেই পাখির চোখ করেছেন। গোপীচন্দ অ্যাকাডেমির ভিতর পরপর ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছাড়াও সাঁতারের পুল আর একটা বড় ফুটবল মাঠ। এখানে শিক্ষার্থীদের লং ডিস্টেন্স রানিং করানো হয়। জিজ্ঞেস করা হল না, দু’দিকে নেট টাঙানো এত বড় ফুটবল মাঠে সিন্ধু-শ্রীকান্তদের ফুটবলও খেলানো হয় কি না?
গোপীচন্দ শিবিরের সঙ্গে যুক্ত জনৈক কর্তা বললেন, ‘‘সিন্ধু এ বার আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। গোপী ওকে ওয়ান ইজ টু থ্রি প্র্যাকটিস দিচ্ছে। মানে এক দিকে সিন্ধু একা। ও দিকে নেটের সামনে দু’জন। পিছনে এক জন। অর্থাৎ তিন জন প্রতিপক্ষের সঙ্গে একা খেলতে হচ্ছে।’’
হায়দরাবাদ শহরতলির কোকাপেট-এ নতুন বাড়ি করেছেন সিন্ধু। তাঁর আগের বাড়ি গোপীচন্দ অ্যাকাডেমির থেকে এত দূরে ছিল যে আসতে-যেতেই তিন ঘণ্টা চলে যেত। এখনকার বাড়ি কোকাপেট থেকে গোপীর অ্যাকাডেমি পনেরো মিনিট। ভিতরে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। বাইরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঢুকে মনে হল এটা তারকার বাড়ি। তবে অলিম্পিক্সে রুপো পাওয়ার আগে কেনা।
সিন্ধুকে আজ পর্যন্ত যিনি সচিনের হাত দিয়ে তিনটে গাড়ি উপহার দিয়েছেন, সেই চামুণ্ডেশ্বরনাথ নিয়ে গেলেন সেখানে। পরিচয় হল সিন্ধুর বাবা পিভি রামানা আর মা পি বিজয়ার সঙ্গে। বাবা ছ’ফুট দুই। মা পাঁচ ফুট দশ। দেখে মনে হল সিন্ধুর এ রকম কাঠামো হওয়া তো জিনেই অনিবার্য ছিল। সকালে গোপীচন্দকে দেখলাম কার্যত মাথা ন্যাড়া অবস্থায়। দু’সপ্তাহ আগে তিরুপতিতে পদক জয়ের মানত হিসেবে চুল দিয়ে এসেছেন গোপী। আর সিন্ধু দিয়েছেন ৬৫ কিলোগ্রাম চিনি। নিজের ৬৫ কেজি ওজন পিছু এক কিলো চিনি। সিন্ধুর বাবা-মা দু’জনেই নামী ভলিবলার। বাবা তো অর্জুন পেয়েছেন। বাইরের ঘরে বিশাল যে এলইডি টিভিটা লাগানো রয়েছে, সেখানেই কি রিওতে মেয়ের ম্যাচ দেখেছেন? বললেন, ‘‘না, এত টেনশন ছিল যে সেমিফাইনালে অ্যাকাডেমিতে চলে যাই। আর ফাইনালে বাড়ি থেকে বেরোতেই হয়েছিল কারণ মিডিয়া কার্যত অবরোধ করে রেখেছিল পুরো রাস্তা।’’
রামানা আর বিজয়া দু’জনেই বললেন, ‘‘অসম্ভব মনের জোর সিন্ধুর। সেই কবে ছোট বয়স থেকে ও শিওর ছিল ব্যাডমিন্টন খেলে বড় জায়গায় যাবে। এখন নিজেদেরই অবাক লাগে যে এত কম বয়সে কোথা থেকে এত মনের জোর পেয়েছিল।’’ কথা বলতে বলতে রিওর পদকটা নিয়ে এলেন মা। ব্যাপক ভারী। অন্তত ৪ কেজি ওজন হবে।
রামানা কি আনন্দবাজারের জন্য এটা গলায় ঝুলিয়ে একটা ছবি তুলবেন? বললেন, ‘‘না, এটা মেয়ের পদক। আমার নয়। আমার অর্জুন পুরস্কার নিয়ে বলুন, এখুনি ছবি তুলছি।’’ শৌখিন সুন্দর করে সাজানো ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। বাইরের ঘরের শো-কেসটা ট্রফিতে ভরে গিয়েছে। মা নিয়ে এলেন রাজীব খেলরত্ন পুরস্কারও। সযত্নে নিয়ে গেলেন অলিম্পিক্স পদক। যা দেখে মনে পড়ে গেল একটু আগে অ্যাকাডেমিতে বসে সিন্ধু বলছিলেন, ‘‘পদকটা এখন কোনও একটা সুরক্ষিত জায়গায় ঢোকাতে হবে। এই ক’দিন মিনিস্টাররাও দেখতে চাইছিলেন বলে সব প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে হয়েছে। এ বার হয় ব্যাঙ্কের লকার। বা বাড়িতে কোনও সিকিওরিটি ভল্ট করে তার মধ্যে রাখা।’’
বাড়িতে ভিনরাজ্যের অতিথি। সঙ্গে অভিভাবক সদৃশ চামুণ্ডেশ্বরনাথ। সিন্ধু এক বারের জন্যও নামলেন না। দু’দফার প্র্যাকটিস সেরে এসে এটা তাঁর বিশ্রামের সময়। এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে আবার তো ফিরে যেতে হবে অ্যাকাডেমিতে। সেখানে তৃতীয় সেশন শুরু হবে।
বললাম না, আইসক্রিম-বিরিয়ানি ছুটির মাসটা কালকেই শেষ হয়ে গিয়েছে!.
ছবি গৌতম ভট্টাচার্য