হোলির রংয়ে দীপাবলি ভারতে।
তিনশো কিলোমিটার দূরেই নাকি চলছে তাঁদের মুণ্ডপাত। ওয়াঘার ও পারে। জ্বলছে কুশপুতুল। পদদলিত হচ্ছে তাঁদের ছবি।
সে খবর নিয়েই রবিবার দুপুরে ওয়াঘার এ পারে এসে নামলেন শাহিদ আফ্রিদিরা। ঘুমঘুম চোখে। কলকাতা থেকে কাকভোরের বিমান ধরে। তবে এসে যা দেখলেন, তাতে তাঁদের ঘুম ভাঙানোর রসদ আছে ষোলো আনা।
চণ্ডীগড় এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা টিম বাসে ওঠার সময় যে ঠান্ডা, দমকা হাওয়া গায়ে এসে লাগল ওয়াহাব রিয়াজ, ইরফান খান, মহম্মদ সামি, মহম্মদ আমেরদের, তাতে তাঁদের হাত নিশপিশ করাটাই স্বাভাবিক।
সকালে বৃষ্টি হয়েছে কয়েক পশলা। সারা দিন ধরে টানা, ঝিরঝিরে বিরক্তিকর বৃষ্টি নয়। কলকাতার শরতের বৃষ্টির মতো খামখেয়ালি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত কয়েক দিন ধরেই এমন অকাল বৃষ্টির আবির্ভাব ঘটছে শহরে। রোদের উষ্ণতাও মিলছে না তেমন। তীব্র গরম যাতে চণ্ডীগড়বাসীদের কাবু করতে না পারে, সে জন্যই যেন মাঝে মাঝে আচমকা টহল দিয়ে যাচ্ছে এই বৃষ্টি।
‘’আমার বাড়ির বাইরে সবাই বাজি ফাটাচ্ছে, হর্ন বাজাচ্ছে, চিৎকার করছে। তোমরা সবাই আমার মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দেবে। এখন ও খুব ছোট বোঝার জন্য ভারত-পাক ম্যাচ কী! ওকে এক দিন আমি নিশ্চয়ই বলব। ও জানে না ওর বাবা কী।’’
টুইটারে সাক্ষী
একেই এ রকম আর্দ্র আবহাওয়া। তার উপর যদি সোমবার বিকেলে আমেররা অনুশীলন করতে গিয়ে দেখেন মাঠের মাঝখানের বাইশ গজেও ঘাস আছে বেশ খানিকটা, চিফ কিউরেটর দলজিত সিংহ যদি তাঁদের বলে দেন, ঘাসটা থাকবে, তা হলে তো কথাই নেই। আমের, সামিদের মুঠো আর আফ্রিদির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই।
দলজিত রবিবার আনন্দবাজারকে সে রকমই জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘এখানকার উইকেট এখন পুরনো হয়ে গিয়েছে। তাই ঘাস ছেড়ে রাখতেই হবে। ঘাস তুলে দিতে গেলে উল্টোপাল্টা টার্ন হবে। সেটা আমি চাই না।’’ কয়েক মাস আগে তিন দিনে শেষ হওয়া ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্টের অভিজ্ঞতার কথা এখনও যে ভোলেননি, বোঝাই যাচ্ছে।
এই শহরেই শেষ দুটো ম্যাচ আফ্রিদিদের। যা তাঁদের লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে। আবার বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের রাস্তাও পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে এই দুই ম্যাচেই। এ রকম একটা সময়ে এমন কন্ডিশনের কথা জেনে তাই কিছুটা হলেও আশাবাদী পাক শিবির।
ফের ‘মওকা’ হারিয়ে ফুটছে পাকিস্তান।-টুইটার
দুপুরে হোটেলে ঢুকে লাঞ্চ সেরে যখন দলের সবাই দিনের শেষে ঘুমের দেশে, তখন লবিতে দাঁড়িয়ে দলের সঙ্গে থাকা মিডিয়া ম্যানেজার আগা আকবর বলছিলেন, ‘‘সত্যিই এখানকার আবহাওয়া আমাদের ছেলেদের মনে আশা জাগিয়েছে। এই আবহাওয়ার খবর অবশ্য আমরা আগেই পেয়েছি। কলকাতায় থাকতেই। কাল উইকেটটাও দেখতে হবে। তার পর প্ল্যানিং।’’ তবে তাঁর দাবি, শনিবারের হারের পর দলের মধ্যে ভেঙে পড়া বা একে অপরকে দোষারোপ করার কোনও মানসিকতা নেই। ‘‘আজকের দিনটা ভাল করে বিশ্রাম নিয়ে কাল থেকে ফের ঝাঁপিয়ে পড়া, এখন এটাই আমাদের কাজ’’, বললেন আগা।
কলকাতা থেকে চণ্ডীগড় আসার পথে সহযাত্রী পাকিস্তানি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই শোনা গেল, সে দেশের বোর্ড নাকি ঠিক করে ফেলেছে, পাকিস্তান বিশ্বকাপে সফল হোক বা না হোক, আফ্রিদি আর ওয়াকারকে আর দায়িত্বে রাখা হবে না। এমনকী সিলেকশন কমিটিকেও ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে দেওয়া হবে। বোর্ডের এই ফতোয়ার পর কী করে শেষ দুই ম্যাচে ভাল খেলার প্রেরণা পাবেন পাক ক্রিকেটাররা? যার উত্তরে আগা বলছেন, ‘‘এগুলো নিয়ে এখন দলের কেউই মাথা ঘামাচ্ছে না। আফ্রিদি তো এমনিতেই বিশ্বকাপের পর সরে যাবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। এখন তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে, এ সব খবরের মানে কী?’’
ভারতের কাছে হার নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ পিসিবি চেয়ারম্যান শাহরিয়ার খান। শনিবার রাতে ক্লাব হাউসের একতলায় হোটেলে ফেরার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার সময় বলছিলেন, ‘‘এরা কী করে ভারতকে হারাবে? এদের কোনও ফোকাসই নেই। কোন সময় কোন বলটা করা দরকার, কাকে কী ভাবে আউট করতে হবে, তার কোনও প্ল্যানিংই নেই। এই টিম নিয়ে বড়াই করার কিছুই নেই আমাদের।’’ পাক বোর্ড প্রধানের এ হেন মনোভাব জানার পর খবরটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বোধহয়।
দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট প্রশাসক যখন এই জায়গায়, তখন রবিবার সন্ধ্যায় ওয়াসিম আক্রমকে এক সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে বসে বলতে শোনা গেল, ‘‘এই টিমের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারানোর ক্ষমতা আছে বলে আমার বিশ্বাস।’’ জাহির আব্বাসও বলছেন, ‘‘মাথা ঠান্ডা রেখে খেললে এই টিমটাই ভাল খেলবে।’’ হোটেলে ফিরেও নাকি শোয়েবরা নিজেদের মধ্যে একই রকম আলোচনা করতে করতে যে যাঁর ঘরে ঢুকেছেন। সাংবাদিক বৈঠকে শোয়েব মালিকের গলাতেও প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন মাঠে কতটা হবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
আফ্রিদিদের টিম হোটেলের আধ কিলোমিটার দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে পাঁচতারা হোটলকে পুরো দূর্গ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কলকাতায় এক সপ্তাহ থাকা পাক দলের জন্যও নিরাপত্তার এই বহর দেখা যায়নি। শোনা গেল, তিন দিন আগে নাকি গোয়েন্দা সূত্রে খবর এসেছে মোহালিতে আফ্রিদিদের টিম বাসে বা হোটেলে হামলা করার ছক কষছে এক জঙ্গি সংগঠন। সেই ছক ফাঁস হতেই নিরাপত্তার বহর পাঁচ গুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাক ক্রিকেটারদের নিজেদের ঘর থেকে নড়াচড়া করাই নাকি বন্ধ। শুধুমাত্র প্র্যাকটিস ও ম্যাচের সময় ছাড়া।
এই পাহাড়প্রমাণ নিরাপত্তাবলয় না হয় হোটেল ও মাঠের বাইরে। কিন্তু মঙ্গলবার মোহালিতে যখন মাঠে নামবেন সরফরাজ, সার্জিলরা, তখন গাপ্টিল, অ্যান্ডারসন, টেলর, ম্যাকক্লেনাঘান, সোধিদের হাত থেকে তাঁদের কে বাঁচাবে?
সেই যুদ্ধে ঠিকঠাক গোলাগুলি চালাতে না পারলেই তো সব শেষ।