চিনের প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে নতুন মুকুট সিন্ধুর

অলিম্পিক্সে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ইতিহাস গড়ার পরে বিশ্ব মঞ্চে তাঁর প্রত্যাবর্তনটা ছিল অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স! রিও থেকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ১১৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম অলিম্পিক্স রুপো নিয়ে আসার পরে কোর্টে ফিরে পরপর দু’টো টুর্নামেন্ট ডেনমার্ক আর ফরাসি ওপেনের দ্বিতীয় রাউন্ডে ছিটকে যান।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩১
Share:

কেরিয়ারের প্রথম সুপার সিরিজ জিতে সাইনা।

অলিম্পিক্সে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ইতিহাস গড়ার পরে বিশ্ব মঞ্চে তাঁর প্রত্যাবর্তনটা ছিল অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স! রিও থেকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ১১৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম অলিম্পিক্স রুপো নিয়ে আসার পরে কোর্টে ফিরে পরপর দু’টো টুর্নামেন্ট ডেনমার্ক আর ফরাসি ওপেনের দ্বিতীয় রাউন্ডে ছিটকে যান। একই চিনা প্লেয়ারের কাছে হেরে। পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধুর কি তা হলে অলিম্পিক্স সাফল্য ফ্লুক— এমন ফিসফাস যখন শুরু হব হব, পুলেল্লা গোপীচন্দ দু’টো মন্তব্য করেছিলেন।

Advertisement

‘‘সিন্ধুর অফ ফর্মটা সাময়িক।’’

‘‘একজন চ্যাম্পিয়নের থেকেও বেশি দরকার একটা চ্যাম্পিয়নের মানসিকতা।’’

Advertisement

বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের শাসক দেশ চিনের মাটিতে গুরু গোপীর দু’টো কথাকেই সত্যি প্রমাণ করে ছাড়লেন গুরুকুলের সবসেরা শিষ্য— পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু। ডেনমার্ক, ফ্রান্সের পরের টুর্নামেন্টেই। চিন ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে। তিন বছর আগে চিনের প্রাচীরে ফাটল ধরিয়েই সিন্ধুর ব্যাডমিন্টনের বিশ্ব মঞ্চে ঝলমলে আত্মপ্রকাশ। সেটা ছিল ২০১৩-এ গুয়াংঝৌয়ে মাত্র আঠারো বছরের মেয়ের প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্ব ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে সিঙ্গলসে পদক (ব্রোঞ্জ) জয়। রবিবার চিনের অন্য শহর ফুঝৌ থেকে সিন্ধুর মুকুটে উঠল আর একটা নতুন পালক। তাঁর জীবনের প্রথম সুপার সিরিজ খেতাব।

আগের দিন সেমিফাইনালে কোরিয়ার সুং জি হিউনের বিরুদ্ধে প্রথম গেম হেরেও শেষ দু’টোয় বিপক্ষকে ২১ আর ১৯ পয়েন্টে আটকে অসাধারণ জিতে ফাইনালে উঠার পরে রবিবার আরও একটা অনবদ্য জয় ছিনিয়ে নিলেন হায়দরাবাদের একুশ বছরের তরুণী। সুন ইউ-এর স্থানীয় চিনা চ্যালেঞ্জকে বশ মানালেন ২১-১১, ১৭-২১, ২১-১১। সুন দ্বিতীয় গেম জিতে ১-১ করে ফেলার পরে ফাইনালের মীমাংসাসূচক গেমে সিন্ধুকে খেলতে হয়েছে শুধু নেটের উল্টো দিকে তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গেই নয়, ফুঝৌয়ের স্টেডিয়াম ঠাসা চিনা সমর্থকদের বিপক্ষেও! চিনের মাটিতে এই খেতাব জেতার নজির রবিবারের আগে পর্যন্ত আর মাত্র একজন ভারতীয় মেয়েরই ছিল। তিনি সাইনা নেহওয়াল। সম্ভবত সে জন্য এ দিন সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে সিন্ধু বলেছেন, ‘‘সাইনা যেটা দু’হাজার চোদ্দোয় করেছিল আমিও সেটা করলাম। খুব আনন্দ হচ্ছে।’’

টুর্নামেন্টে পাঁচটার মধ্যে তিনটে ম্যাচ সিন্ধু জেতেন তিন গেমে। যার মধ্যে দু’টো ম্যাচে প্রথম গেম হেরে পিছিয়ে পড়া সত্ত্বেও। প্রতিপক্ষের ১৯, ২০, ২২ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থার মতো প্রবল চাপের সামনে সিন্ধু এই টুর্নামেন্টে জিতেছেন মোট পাঁচটা গেম। তাই শুধু চ্যাম্পিয়ন হওয়াই নয়, সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন মানসিকতাও চিনে দেখালেন সিন্ধু।

সাফল্যের উচ্ছ্বাস। ছবি: পিটিআই

লি জুরুই, ইহান ওয়াং, শিজিয়ান ওয়াং-এর মতো চিনের শীর্ষস্থানীয় তারকারা এই টুর্নামেন্টে হয়তো খেলেননি। সে তো ইন্ডিয়ান ওপেনেও সাইনা নেহওয়াল কত বার খেলেন না। কিন্তু বিশ্বের এক নম্বর তথা অলিম্পিক্স সোনাজয়ী ক্যারোলিনা মারিন থেকে শুরু করে প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রাতচানক ইন্তানন, শেষ দু’টো টুর্নামেন্টে সিন্ধুকে হারানো চিনের হে বিংজিয়াও— অন্য হেভিওয়েটরা প্রায় সবাই ছিলেন চিনা ওপেনে। এহেন মঞ্চ থেকে জীবনের প্রথম সুপার সিরিজ খেতাব তুলে নিলেন ছিপছিপে চেহারার সিন্ধু। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে শেষ তিনটে ম্যাচে সুপার সিরিজের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা তিন প্রতিপক্ষকে টানা হারিয়ে। সুপার সিরিজের ক্রমপর্যায়ে সিন্ধু ১৪ নম্বর। সেখানে চিন ওপেনে শেষ আট থেকে ভারতীয় তরুণীর হাতে একে-একে বধ হওয়া বিংজিয়াও পাঁচ, হিউন ছয় এবং ইউয়ের র‌্যাঙ্কিং চার।

হয়তো সে কারণেই প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে সিঙ্গলসে পদকজয়ী, অলিম্পিক্স ফাইনালিস্ট সিন্ধুকেও চিন ওপেন জিতে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত দেখিয়েছে এ দিন। ‘‘আমার বহু দিনের স্বপ্ন সত্যি হল আজ। সুপার সিরিজ খেতাব জয়ের স্বপ্ন আমার অনেক দিনের,’’ বলেছেন সিন্ধু। সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘‘রিওর পরে প্রত্যেকে আমাকে জি়জ্ঞেস করতেন, এর পর কী? তাই এই সুপার সিরিজ খেতাব জেতাটা আমার কাছে আরও বেশি তাৎপর্যের।’’ এই টুর্নামেন্টে তাঁর সার্বিক পারফরম্যান্স সম্পর্কে সিন্ধুর ব্যাখ্যা, ‘‘প্রথম রাউন্ড থেকে কঠিন লড়াই ছিল। কিন্তু গোটা টুর্নামেন্টে আমি ভাল খেলেছি। প্রচুর প্র্যাকটিস করে এখানে নেমেছিলাম। তাই বিশ্বাস ছিল যে, নিজের সেরাটা দিতে পারব। সেটা পেরেছি বলে জিতেছি।’’

আর ফাইনালে চিনের মেয়েকে হারানো প্রসঙ্গে সিন্ধুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘প্রায় আড়াই বছর পরে সুনের বিরুদ্ধে খেললাম আজ। আমরা দু’জনেই অ্যাটাকিং প্লেয়ার। তাই কেউ একটাও শাটল ছাড়িনি। সে জন্য লম্বা র‌্যালি হল বেশি। শেষ পর্যন্ত আমার লাফিয়ে উঠে মারা স্ম্যাশগুলো কাজে দিয়েছে। তবে সেরা ম্যাচ ছিল সেমিফাইনালে হিউনের সঙ্গে। আমার জীবনের অন্যতম সেরা জয় ওটা।’’ আর সবচেয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন কোয়ার্টার ফাইনালে আর এক চিনা প্রতিপক্ষ বিংজিয়াওকে হারিয়ে। ‘‘ও গত মাসে আমাকে ডেনমার্ক আর ফ্রান্সে হারিয়েছিল। তাই ওকে ওর দেশের মাটিতে স্ট্রেট গেমে হারাতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছে,’’ সাফ কথা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের বর্তমান মুখের!

++++++++++++++++++++++++

সপাটে থাপ্পড়!

শুধু ট্রফি নয় সিন্ধুর রবিবারের জয় চিনকে মুখের মতো জবাব, বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় পড়ে গিয়েছে। চিনের ফুঝৌতে চিন ওপেন সুপার সিরিজ টুর্নামেন্টে সাইনা-সিন্ধুদের টিম ম্যানেজার বামাঙ্গ টাগো কূটনৈতিক কারণে ভিসা পাননি। অভিযোগ উঠেছিল অরুণাচলপ্রদেশের লোক বলে চিন সরকার তাঁর ভিসা নিয়ে সমস্যা তৈরি করে। অরুণাচল সীমান্ত নিয়ে চিন-ভারত বিবাদ দীর্ঘ দিনের। সেখানেই সমস্যা। চিন সরকার অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে পাল্টা দাবি করে, বামাঙ্গ নিজেই তাঁর ভিসা বাতিল করেছেন। যেটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। ক্ষোভে ফুটছিলেন ভারতীয় সমর্থকরা। সেই আঁচই যেন পাওয়া গেল সিন্ধুর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর। এক ভারতীয় সমর্থক টুইট করেছেন,‘‘সিন্ধু ট্রফি জিতে চিন সরকারের মুখে সপাটে চড় কষাল। যারা অরুণাচলের লোক বলে ভারতীয় ম্যানেজারের ভিসা বাতিল করেছিল।’

• বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ফের প্রথম দশে চলে এলেন।

• কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে টানা তিন ম্যাচে হারিয়েছেন সুপার সিরিজের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজের চেয়ে উঁচু ক্রমপর্যায়ের খেলোয়াড়কে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement