বলছেন সেই রাতের রক্ষী, অভিশপ্ত অস্কার-গৃহে আজও বিস্ময়

আঁতকে উঠেছিলাম রক্তাক্ত রিভাকে দেখে

ক্রীড়া বিশ্বের সব চেয়ে আলোচিত, বীভৎসতম হত্যাকাণ্ডের স্থলে গিয়ে প্রথমেই বোঝা গেল, পাঁচ বছর পরে এখনও চূড়ান্ত কড়াকড়ি আর সতর্কতা। গেটের সামনেই পরিষ্কার লেখা রয়েছে, কোনও অনুমতি ছাড়া ভিতরে ঢুকতে গেলে সম্পূর্ণ দায় আগন্তুকের।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

জোহানেসবার্গ শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:২১
Share:

প্রিটোরিয়ার কাছে সেই আবাসন। এক সময় যেখানে থাকতেন অস্কার পিস্টোরিয়াস। সামনে নিরাপত্তারক্ষী পিটার বাবা। নিজস্ব চিত্র

সিলভারউড্‌স কাউন্টি এস্টেট।

Advertisement

প্রিটোরিয়া শহর থেকে অনেকটা ভিতরে অবস্থিত একটি হাউজিং কমপ্লেক্স। বাইরে দাঁড়িয়েই বোঝা যায়, উচ্চবিত্তদের বাসস্থান। বিকেল বেলাতেই কী রকম নিঃঝুম। দেখে মনে হবে যেন কোনও ঘুমন্ত পুরীতে এসে উঠলাম।

ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে অবশ্য এই এস্টেটের সামনে দাঁড়িয়েই বুকের মধ্যে এখনও ছ্যাৎ করে ওঠে। পাঁচ বছর আগের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র ভোর রাতে এই ঘুমন্তপুরীই যে হয়ে উঠেছিল হত্যাপুরী! সারা পৃথিবীর নজরে চলে এসেছিল ‘সিলভারউড্‌স’ নামটা। কোনও এক অস্কার পিস্টোরিয়াস যে এখানেই থাকতেন। আর ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই আবাসনের ভিতরেই খুন হন অস্কারের বান্ধবী রিভা স্টিনক্যাম্প।

Advertisement

ক্রীড়া বিশ্বের সব চেয়ে আলোচিত, বীভৎসতম হত্যাকাণ্ডের স্থলে গিয়ে প্রথমেই বোঝা গেল, পাঁচ বছর পরে এখনও চূড়ান্ত কড়াকড়ি আর সতর্কতা। গেটের সামনেই পরিষ্কার লেখা রয়েছে, কোনও অনুমতি ছাড়া ভিতরে ঢুকতে গেলে সম্পূর্ণ দায় আগন্তুকের। তিনি যদি প্রাণ হারান বা আঘাত পান, সেই দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের নয়। নির্দিষ্ট করে বলা আছে, মিডিয়ার প্রবেশ নিষেধ।

পাঁচ বছর আগের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সেই রাতে কর্তব্যরত নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে ছিলেন পিটার বাবা। তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল এখানে। তাঁর মুখ থেকে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গেল। ঘটনার দিন রিভা সারা দিন ধরেই ছিলেন অস্কারের বাড়িতে।

এস্টেটের নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির মালিকের অনুমতি না নিয়ে কোনও অতিথি প্রবেশ করতে পারবে না। গেটের নিরাপত্তারক্ষীরা আগে ফোন করবেন বাড়ির কর্তাকে। তিনি বললে তবেই অতিথি ভিতরে যেতে পারবেন। রিভার জন্য আগে থেকেই অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন অস্কার। ভয়াবহ সেই দিনের কথা মনে করতে গিয়ে পিটার বললেন, ‘‘আমি সন্ধেবেলায় ডিউটিতে এসেছিলাম। রিভা তার আগে বেরিয়েছিল। সারা দিন ও এখানেই ছিল। মনে হয় ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করছিল ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে। তার পর বেরিয়েছিল। যখন সন্ধেবেলায় আবার ঢুকছে, তখন আমি গেটেই ছিলাম। আমার সঙ্গে কথাও বলেছিল ও।’’ কী বলেছিলেন রিভা? নিরাপত্তারক্ষী যোগ করলেন, ‘‘ও খুবই হাসিখুশি, মিশুকে ধরনের ছিল। এখানে এলেই আমাদের সঙ্গে কথা বলত। সে দিনও সে রকমই স্বাভাবিক কথা হয়েছিল।’’ রিভা কেন বেরিয়েছিলেন জানতে পেরেছিলেন? জিজ্ঞেস করায় উত্তর মিলল, ‘‘শুনেছিলাম, অস্কারকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র সার্প্রাইজ গিফ্‌ট দেবে বলে কিছু কিনতে বেরিয়েছিল।’’ ভোর রাতের সেই ঘটনার কথা মনে করতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন পিটার। অস্কারের প্রতিবেশিদের থেকে গেটে প্রথম ফোন আসে। পিটারই সেই ফোনটা ধরেন। প্রতিবেশী ফোনে বলেছিলেন, ব্লেড রানারের বাড়ি থেকে গুলির শব্দ শুনেছেন।

এস্টেটের ভিতরে ফ্ল্যাট নয়, প্রত্যেক মালিকের রয়েছে আলাদা আলাদা বাড়ি। অস্কারেরও তেমনই বাড়ি ছিল। সেখানে ছুটে যান পিটার। তিনি হাজির হতেই রিভাকে কোলে করে নিয়ে নেমে এসেছিলেন অস্কার। রক্তাক্ত রিভাকে দেখে পিটার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, কী ভাবে এমন কাণ্ড ঘটে গেল। ‘‘আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিস্মিত, হতবাক অবস্থায় শুধু অস্কারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।’’ সে দিনই বাড়ি ঢোকার সময় গেটে অস্কারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন পিটার। সন্ধেবেলায় কথা হয়েছিল রিভার সঙ্গেও। তিনি ভাবতেই পারছিলেন না, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে এমন ভয়াবহ কাণ্ড কী করে ঘটল।

আদালতে রিভার মৃত্যু মামলায় অন্যতম সাক্ষী নিরাপত্তারক্ষী পিটার। সেই রাতে কিছুক্ষণ পরে অ্যাম্বুল্যান্সে করে ডাক্তার এসে রিভাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অস্কার-কে। আদালতে পরে অস্কার স্বীকার করে নেন যে, তাঁর গুলিতেই রিভার মৃত্যু হয়। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে তিনি মারেননি বান্ধবীকে। আগন্তুক ঢুকেছে ভেবে গুলি চালিয়েছিলেন।

এখনও প্রিটোরিয়ার এই অঞ্চলের বাসিন্দারা অস্কারের কথা বিশ্বাস করেন না। বরং স্থানীয়দের মুখে এখনও নানা কাহিনি শোনা যাবে। প্রত্যেকেই বলবেন, বরাবরই খুব বদমেজাজি ছিলেন অস্কার এবং তাঁর ভাই। এক বার রেস্তোরাঁয় গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন অস্কার। আর এক বার তাঁর ভাই গাড়ি চালাতে চালাতে শূন্যে গুলি ছুড়ে পালিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে তাড়া করেছিল। আপনি কখনও বদমেজাজি অস্কারকে দেখেছেন? পিটার কিছুটা সাবধানী হয়েই উত্তর দিলেন, ‘‘আমরা কখনও সে রকম কিছু দেখিনি। ওদের দু’জনকে তো খুব হাসিখুশিই দেখতাম।’’

স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ কেউ যদিও অন্য কাহিনি শোনাবেন। এঁদের মুখে এখনও ঘুরছে রিভার সঙ্গে এক রাগবি খেলোয়াড়ের ঘনিষ্ঠতার কথা। স্থানীয় মত হচ্ছে, সেই রাতে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছিল এই রাগবি খেলোয়াড়কে নিয়ে। যাঁকে নাকি রিভার সঙ্গে প্রায়ই দেখা যাচ্ছিল।

পিটার অবশ্য সে সব জানেন না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘‘সেই রাতে কী ঘটনা ঘটেছিল, জানে শুধু দু’জনে। এক জন চলে গিয়েছে— রিভা। অন্য জন হাজতে। যদি কখনও বই লেখে অস্কার, হয়তো সত্যিটা জানা যাবে।’’ পিটার জানালেন, পরে তাঁকে মনোবিদের কাছেও যেতে হয়েছিল। ঘটনার বীভৎসতায় তিনি মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলেছিলেন।

আরও জানা গেল, অস্কার তাঁর বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন সেখানে নতুন মালিক থাকেন। কিন্তু এস্টেটের নিয়ম অনুযায়ী, ফাঁস করা যাবে না কে সেই বাড়ি কিনেছেন। অস্কার এখনও জেলে। ছয় বছরের কারাদণ্ড বেড়ে তেরো বছর হয়ে গিয়েছে। তবে তাঁর আইনজীবীরা ফের আবেদন করতে পারেন। ‘‘জানি না রিভা কীসের জন্য এত বড় শাস্তি পেল। অস্কারও তো সাজা কাটছে। এটা ভাবলেই সব চেয়ে খারাপ লাগে যে, দু’টো তরতাজা প্রাণ কী রকম তছনছ হয়ে গেল,’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন পিটার। বহু সকালে অস্কারকে যিনি ট্রেনিং করতে যেতে দেখেছেন। ‘‘কে চিনত না ওকে। খুবই জনপ্রিয় ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার গর্ব ছিল,’’ বলে ওঠেন তিনি।

একটা শেষ প্রশ্ন মাথায় আসে। রিভার বাবা-মা কখনও এ বাড়িতে এসেছেন? পিটার বলে দেন, ‘‘না, অস্কারের পরিবারকে আসতে দেখেছি। রিভার বাবা-মাকে কখনও দেখিনি। উঁহু, কখনও না।’’

খটকা লাগে শুনে। কোথাও কি থেকেই গিয়েছিল একটা সন্দেহের সুর? প্রেম দিবস তাই হয়ে উঠেছিল হত্যা দিবস?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement