সাজা ঘোষণার পর প্রিটোরিয়ার আদালতে ‘ব্লেড রানার’। ছবি: এপি
কারাদণ্ড না আরও কঠিন সাজা!
জল্পনার শেষ। বান্ধবী রিভা স্টিনক্যাম্পকে অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে ‘ব্লেড রানার’ অস্কার পিস্টোরিয়াসকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল দক্ষিণ আফ্রিকার আদালত।
সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখার পর বিচারক থোকোজিলে মাসিপা মেনে নিলেন, স্বেচ্ছায় খুন না করলেও স্টিনক্যাম্পের মৃত্যুর পিছনে পিস্টোরিয়াসের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের বড় ভূমিকা ছিল। স্টিনক্যাম্প-হত্যার পাশাপাশি, আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত একটি মামলাতেও এ দিন তিন বছরের জেল হয় ‘ব্লেড রানার’-এর। এই শাস্তিটি অবশ্য আপাতত স্থগিত রয়েছে।
মঙ্গলবার সাতসকালেই প্রিটোরিয়ার আদালতে পৌঁছে যান বছর সাতাশের পিস্টোরিয়াস। সঙ্গে ছিলেন পরিজনেরা। কোনও কিছু না বলে সটান চলে যান আদালত কক্ষে। আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর আইনজীবী ব্যারি রু। আদালত চত্বর তখন ভিড়ে ঠাসা। ছিলেন স্টিনক্যাম্পের বাড়ির লোকজনও। কাঠগড়ায় উঠলেন ‘ব্লেড রানার।’ থমথমে মুখ। কপালে ভাঁজ। চোখে-মুখে প্রবল মানসিক চাপের ছাপ স্পষ্ট। বিচারক যখন রায় ঘোষণা করলেন, চোখ থেকে জল গড়িয়ে এল পিস্টোরিয়াসের। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই বমি করে ফেললেন। ‘রানিং ট্র্যাকে’ কোনও দিন হার না মানলেও, জীবনের এই দৌড়টাতে হেরে গেলেন কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্প্রিন্টার হয়ে ওঠা অস্কার।
গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে পিস্টোরিয়াসের চালানো গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর বান্ধবী রিভা স্টিনক্যাম্পের। পিস্টোরিয়াস বরাবরই দাবি করে এসেছেন, সে দিন রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে বাথরুমে আওয়াজ শুনতে পেয়ে তিনি ভেবেছিলেন, বাড়িতে দুষ্কৃতী ঢুকেছে। আতঙ্কে কিছু না ভেবেই দরজা লক্ষ্য করে পরপর চারটি গুলি চালিয়ে দেন তিনি। দরজার উল্টো দিকে স্টিনক্যাম্প রয়েছেন সে কথা ভাবেননি তিনি। নাইন এমএম পিস্তলটি থেকে চালানো গুলি এসে লাগে স্টিনক্যাম্পের মাথায়, কোমরে। এরই মধ্যে প্রিটোরিয়ায় পিস্টোরিয়াসের প্রতিবেশী মিশেল বার্গার দাবি করেন, ঘটনার দিন স্টিনক্যাম্পের সঙ্গে দীর্ঘ বাদানুবাদ হয়েছিল অস্কারের। সে সময় চিৎকার করছিলেন স্টিনক্যাম্প।
স্টিনক্যাম্পের মৃত্যু নিয়ে ধন্দ দেখা দেওয়ায় শুরু হয় মামলা। সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে মামলা চলে। পিস্টোরিয়াসের বয়ান নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। তিনি আদৌ সত্যি বলছেন কি না, কিংবা সত্যি আড়াল করার চেষ্টা করছেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরীক্ষা করেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। ১৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনার নাট্যরূপ দিতে আদালতেই তৈরি করা হয় পিস্টোরিয়াসের বাথরুমের মডেল। মামলা চলাকালীন আইনজীবী ব্যারি রু বারবার দাবি করেন, স্টিনক্যাম্পকে হত্যার পিছনে তাঁর মক্কেলের নিরাপত্তার অভাব কাজ করেছিল। স্টিনক্যাম্পকে খুনের অভিসন্ধি ছিল না তাঁর।
এই সাত মাসে ধীরে ধীরে সব কিছু হারিয়েছেন ‘ব্লেড রানার।’ ধুলোয় মিশে গিয়েছে খেলার জগতে তাঁর যশ, প্রতিপত্তি। লোভনীয় কনট্র্যাক্টগুলি হাতছাড়া হয়েছে। মামলার খরচ টানতে একাধিক বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ১২ সেপ্টেম্বর দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। পিস্টোরিয়াসের দশ বছরের কারাদণ্ডের আর্জি জানান স্টিনক্যাম্পের আইনজীবীরা।
জন্মের সময় ফিবুলা অস্থি তৈরি না হওয়ায় মাত্র ১১ মাস বয়সেই দু’পায়ের হাঁটুর তলা থেকে বাকি অংশ বাদ চলে যায় পিস্টোরিয়াসের। তবে হার মানেননি ‘ব্লেড রানার।’ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে প্যারা অ্যাথলিট হিসেবে সেরার শিরোপা পান। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের মূল পর্বে স্বাভাবিক স্প্রিন্টারদের সঙ্গে দৌড়নোর অধিকারও ছিনিয়ে নেন। ৪০০ মিটারের দৌড়ে সেমিফাইনালে উঠে গড়ে ফেলেন নয়া ইতিহাস।
লন্ডন গেমসের ছ’মাসের মধ্যে তাঁরই পিস্তলের গুলিতে বান্ধবী স্টিনক্যাম্পের মৃত্যু বদলে দেয় ‘ব্লেড রানার’-এর দুনিয়াটা। ‘সুপারম্যান’ হয়ে ওঠা ‘ব্লেড রানার’ নিমেষে ‘গানম্যান’ হয়ে ওঠেন।
তবে এটাই শুরু নয়। এর আগে একাধিক বার একাধিক মামলায় নাম জড়িয়েছে পিস্টোরিয়াসের। ২০০৯ সালে উনিশ বছরের এক তরুণীকে নিগ্রহের অভিযোগে এক রাত জেল খাটতে হয়েছিল পিস্টোরিয়াসকে। তার বছর দুয়েক পর প্রাক্তন বান্ধবীর গাড়ির কাচ লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। স্টিনক্যাম্পকে খুনের সপ্তাহ খানেক আগেও জোহানেসবার্গের একটি রেস্তোরাঁয় গুলি চালান পিস্টোরিয়াস। প্রথম দু’টি মামলা তথ্যপ্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে গেলেও রেস্তোরাঁয় গুলি চালানোর মামলায় বিচারক মাসিফা এ দিন ‘ব্লেড রানার’-কে আরও তিন বছরের কারাদণ্ড শোনান। যদিও এই শাস্তিটি এখন স্থগিত রয়েছে। তবে পিস্টোরিয়াসের আইনজীবীদের দাবি, যে আইনে তাঁদের মক্কেলের সাজা ঘোষণা হয়েছে, সে অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে ১০ মাস হাজতে থাকার কথা পিস্টোরিয়াসের। বাকি সময়টা গৃহবন্দি হয়েও থাকতে পারেন। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, “হাজতবাস থেকে গৃহবন্দি হওয়ার প্রক্রিয়া আবেদনসাপেক্ষ।” তবে অর্ধেক সাজা ভোগের পর পিস্টোরিয়াস প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন জানাতে পারেন বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু ধাক্কাটা সামলে ‘ব্লেড রানার’ আদৌ কোনও দিন ট্র্যাকে ফিরতে পারবেন কি না, সন্দিহান তাঁর অগুন্তি সমর্থক।