ফুটবলে প্রিয়দা আর ক্রিকেটে ডালমিয়া ছিল সর্বময় শাসক

প্রিয়বাবু আমার চেয়ে ছোট হলেও আমি ‘প্রিয়দা’ বলতাম। জগমোহনকে  ডাকতাম ‘মিস্টার ডালমিয়া’ বা ‘ডালমিয়া সাহেব’ বলে।

Advertisement

চুনী গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:২৭
Share:

সংগঠক: জগমোহন ডালমিয়া এবং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ফাইল চিত্র

জগমোহন ডালমিয়া চলে গিয়েছিলেন আগে। চলে গেলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিও।

Advertisement

আমি ভাগ্যবান যে, দেশের দুটো সেরা খেলার সর্বোচ্চ পদে থেকে দু’জন কর্তার ‘স্বর্ণযুগ’ পাশাপাশি দেখেছি। এবং ওঁরা যখন কাজ করতেন তখন বঙ্গসন্তান হিসাবে গর্ব হতো এটা ভেবে যে, ক্রিকেট এবং ফুটবলের দু’টো হেডকোয়ার্টারই আমাদের শহরে। ইডেন আর তার একটু দূরের নেতাজি ইন্ডোরের পাশের তৎকালীন অস্থায়ী ফুটবল ফেডারেশনের অফিস গমগম করত সর্বভারতীয় কর্তাদের ভিড়ে। ওঁরা যা নির্দেশ দিতেন, সেটাই নিয়ম হয়ে যেত দেশ জুড়ে। ওদের সময় কত ফুটবল ও ক্রিকেট টিম শহরে এসেছে। কত ধুন্ধুমার নির্বাচন দেখেছি শহরে।

একটা ফুটবল টিমে যেমন দু’জন সেরা স্ট্রাইকারের একসঙ্গে দেখা মেলে না, তেমনই একসঙ্গে এক শহর থেকে দু’জন প্রভাবশালী ও সফল সংগঠকের দেখা পাওয়া কঠিন। একজন বোর্ড প্রেসিডেন্ট, অন্য জন ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট—দেশের কোনও শহর কখনও একসঙ্গে পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। একজন ক্রিকেটের বিশ্বকাপ সংগঠন করে বাহবা পেয়েছেন, অন্য জন ফিফার স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হয়ে এ দেশের ফুটবলকে নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে। দু’জনেই ছিলেন দূরদর্শী। স্পনসর আনা থেকে নিজের খেলাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে দু’জনেই ছিলেন আবেগে ভরপুর।

Advertisement

আরও পড়ুন: শাস্ত্রীর জবাব: ব্যস্ত থাকত অ্যাম্বুল্যান্স

প্রিয়বাবু আমার চেয়ে ছোট হলেও আমি ‘প্রিয়দা’ বলতাম। জগমোহনকে ডাকতাম ‘মিস্টার ডালমিয়া’ বা ‘ডালমিয়া সাহেব’ বলে। ফুটবল এবং ক্রিকেট একসঙ্গে খেলতাম বলে দু’জনের সঙ্গেই সখ্য ছিল। বহু সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। তবে ফুটবলে যাওয়া আসাটা বেশি ছিল। সত্তরের দশকের শুরুতে রঞ্জিতে বাংলার অধিনায়ক ছিলাম, পরে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলাম। সিএবি-তে যেতাম নিয়মিত। তখন ডালমিয়ার সঙ্গে যোগাযোগটা বেশি ছিল। পরে সেটা কমে যায়। তবে উনি কিন্তু মনে রেখেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। যে কোনও ম্যাচের একটা ক্লাব হাউস টিকিট আমাকে নিয়মিত পাঠাত। টিকিটটা বড় ব্যাপার নয়, আসল হল সম্মান। সেটা প্রিয়দাও দিত।

মনে আছে, একবার কী একটা কাজে নেতাজি ইন্ডোরে গিয়েছি। হঠাৎ দেখি প্রিয়দা ডাকছেন। কাছে ডেকে বসালেন। চা খাইয়ে বললেন, ‘জার্মানির বিশ্বকাপ দেখতে যান। আপনারা না গেলে বিশ্ব ফুটবলে ভারতকে চেনাবে কে?’’ বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিলেন পরের দিনই।

সংগঠক হিসাবে দু’জনেই ছিলেন দক্ষ। ডালমিয়া প্রেসিডেন্ট হয়ে দেউলিয়া আইসিসি-কে পৌঁছে দিয়েছিলেন সমৃদ্ধির চূড়ায়। আগে ক্রিকেট দেখানো হত শুধু দূরদর্শনে। হিরো কাপের সময় ঐতিহাসিক মামলা জিতে সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে ডালমিয়া ভারতীয় ক্রিকেটের মানচিত্রটাই বদলে দিয়েছিলেন। ক্রিকেটকে বাণিজ্যকরণ করার তিনি ছিলেন ভগীরথ। যা বদলে দিয়েছিল ক্রিকেটের অভিমুখই। বিসিসিআইকে ধনকুবের তো করে তুলেছিলেন তিনিই। নানা মামলায় জড়িয়ে পরার পরও তিনি ফিরে এসেছিলেন ফের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে। যা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

অন্য দিকে ফিফা বা এএফসি-র মতো সংগঠনের লোকজন তো জানতই না ভারতে ফুটবল খেলা হয়। এই রকম পরিস্থিতিতে ভারতীয় ফুটবলকে বিপণন করেই ফিফায় আমাদের দেশকে জায়গা করে দিয়েছিলেন প্রিয়বাবু। ফিফায় গিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী কর্তাদের নিয়মিত বোঝাতেন, ভারতে ফুটবল কত জনপ্রিয় খেলা। যাতে তাঁরা সাহায্য করেন। যা আইসিসি-তে গিয়ে ডালমিয়া সাহেবকে করতে হয়নি। ভারত ক্রিকেটে বরাবরই শক্তিশালী। সে জন্যই আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট হওয়া যতটা মসৃণ ছিল জগমোহনের কাছে, ফিফার স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হওয়া বা বিশ্বকাপের ম্যাচ কমিশনার হওয়া প্রিয়দার কাছে ততটা সহজ ছিল না।

এখন যে ‘এক দেশ এক লিগ’ কথাটা নিয়ে আলোচনা চলছে ফুটবলে, সেটা তো প্রিয়দাই প্রথম বুঝেছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই জাতীয় লিগ (বর্তমানে আই লিগ) চালু করেছিলেন হোম-অ্যাওয়ে খেলা। যা ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভারতের ফুটবলের অভিমুখ। তিনি চিরিচ মিলোভানের মতো কোচ এনেছিলেন প্রচুর টাকা খরচ করে। শুধু তাই নয়, ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে উপর দিকে না উঠলে দেশের ফুটবলের উন্নতি হবে না, এই ভাবনা তাঁর হাত ধরেই এসেছিল এ দেশে। তবু মিস্টার ডালমিয়ার তো সর্বভারতীয় ক্রিকেট সংস্থার একটা অফিস ছিল, প্রিয়দার তো তা-ও ছিল না। দিল্লিতে দ্বারকা ফুটবল হাউস তৈরি করেছিলেন তিনি। ওই বাড়ির সামনের মাঠটায় স্টেডিয়াম গড়ার স্বপ্নও ছিল সদ্য প্রয়াত মানুষটির। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটা প্রফুল্ল পটেলরা আর করতে পারেননি। পারবেনও না। কারণ প্রফুল্লরা ব্যবসায়ী মানসিকতার লোক। ফুটবলে সেই আবেগ নেই। প্রিয়দা রাজনীতির লোক হলেও ফুটবলটা আবেগ দিয়ে ভালবাসতেন। ডালমিয়াও চাইতেন ক্রিকেট সমৃদ্ধ হোক। প্রচুর স্পনসর এনেছেন দু’জনেই। তবে ফুটবলটা বিক্রি করে দেননি প্রিয়দা। এটা ঠিক, ক্রিকেটে ডালমিয়া যতটা সহজে এগোতে পেরেছেন, প্রিয়দার পথটা তত সহজ ছিল না। সে জন্য একটু হলেও সংগঠক হিসাবে এগিয়ে রাখব সদ্য প্রয়াত মানুষটিকে।

ডালমিয়া ক্রিকেটকে যদি চাঁদ থেকে সূর্যে পরিণত করে থাকেন, তা হলে প্রিয়দা বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে ভারতকে নিয়ে গিয়েছিলেন একক দক্ষতায়। বলা যায়, ভারতীয় ফুটবলের বিশ্বদর্শন তার হাত ধরেই। দু’জনেই চলে গিয়েছেন। বাংলা এ রকম জোড়া সফল ভারত দাপিয়ে বেড়ানো কর্তা পাবে কী না সন্দেহ আছে আমার। অন্তত আমার জীবদ্দশায় দেখতে পাব না নিশ্চিত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement