গলে মাঠের ধারে বিলবোর্ডে। নেটে মার্বেল স্ল্যাব রেখে বিশেষ থ্রো ডাউনের সামনে। ছবি দেবাশিস সেন
ক্রিকেট সাংবাদিক বিদেশি ক্রিকেট সফরে নামা মাত্র তিন ধরনের প্রজাতি একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে তার অন্তত একটা প্যারা তৈরি করে দেয়। সেই তিন প্রজাতির যে কোনও একটা যদি কাজ না করে, বাকিগুলোর ওপর অনিবার্য বিমা করাই যায়।
ইমিগ্রেশন অফিসার: যে পাসপোর্টে ছাপ্পা মারার আগে ক্রিকেট সফর শুনে কিছু না কিছু বলবে।
বিমানবন্দরের ব্যাঙ্ককর্মী: টাকা ভাঙানোর সময় সিরিজ ঘিরে চটকদার এক-আধটু উদ্ধৃতি দিয়েই দিতে পারে।
বিমানবন্দরের বাইরে সাক্ষাৎ পাওয়া ট্যাক্সি চালক: দ্রুত নোট এক্সচেঞ্জ করে নেওয়ার জন্য এরা আইডিয়াল। ক্রিকেটখেলিয়ে কোনও দেশে মিডিয়াকে গাড়িতে তুলেছে জানলে সে ক্রিকেট নিয়ে অবধারিত কিছু বলবেই। হয় ক্রিকেটে উৎসাহ নেই জানিয়ে দেবে। বা বিরাট-অনুষ্কা প্রেম সম্পর্কে তার নিজের ফেসবুক পোস্ট ঠিক কি না, আপনার কাছে ঝালাতে চাইবে।
আর এরও বাইরে রয়েছে শহরের সব বিলবোর্ড! কিছু না কিছু তার নীরব ভাষা থাকবেই। যা জুতসই লেখার লাইন। ঢাকা যেমন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করারই দরকার নেই। টাইগারদের নিয়ে বিশাল বিশাল সব বোর্ড আর বাঘের পাশে সাকিবের ছবিই তো সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া!
দু’হাজার পনেরো মধ্য অগস্টের কলম্বো ক্রিকেট রিপোর্টারকে এই জাতীয় কোনও সহযোগিতায় নারাজ। বিলবোর্ড আছে অজস্র কিন্তু আপাতত সেগুলো ভরা রাজনৈতিক নেতার ছবিতে। আসলে আগামী সোমবার শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচন। দেশে ইলেকশনের মধ্যে ভারতের মতো হাই-প্রোফাইল টিমকে এনে কেউ কখনও ক্রিকেট সিরিজ খেলেছে বলে মনে করতে পারলাম না।
গলে পা দিয়ে অবশ্য সম্রাট সঙ্গকারার অন্তিম টেস্টের আগেরটাকে বরণীয় করে রাখার কিছু বিলবোর্ড পাওয়া গেল। উৎসাহী কিছু মুখও দেখলাম গল ফোর্ট অঞ্চলে। এখানে একটা ডাচ কাফেতে প্রায়ই ডিনার সারতে আসেন কুমার শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট। কাছেই নাকি তাঁর গলের বাড়ি। তা সঙ্গকারার প্রিয় কন্টিনেন্টাল মেনু নিয়ে এখানকার লেনবান স্ট্রিটের কাফেতে ক্রিকেট-উৎসাহী শ্রীলঙ্কান তরুণ অধৈর্য অপেক্ষায়। যদি টেস্টের আগের রাতে এসে পড়েন! স্থানীয় ক্রিকেট কর্তারাও যে কোনও মূল্যে টেস্টকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্কুল-কলেজ ছাত্রদের টিকিট বিলোচ্ছেন। সঙ্গার কোনও ভাবে অমর্যাদা হোক, তাঁরাও চান না।
বৃষ্টিতে সকালের ভারতীয় প্র্যাকটিস নিহত হয়। বুধবার ম্যাচের প্রথম দিনও হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস মেনে কতটা বৃষ্টির জলে আক্রান্ত হয়, এটা ব্র্যাডম্যানকে ছোঁয়ার জন্য সঙ্গার শেষ ডাবল হান্ড্রেডটা হবে কি না, তার চেয়ে বড় জিজ্ঞাসা।
সঙ্গা নিজে অবশ্য বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকেও অক্লান্ত লড়ে যাচ্ছেন। ইডেনে সচিন যেমন তাঁর ঠিক শেষ টেস্টের আগেরটায় অখণ্ড মনযোগ দিয়ে গোটা ভারতীয় প্র্যাকটিস নেটে পড়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শুনলাম গল মাঠের এ দিন মধ্য দুপুরের সঙ্গাও তাই। সচিনের মতোই অবিরত থ্রোয়িং ডাউন প্র্যাকটিস করানো হয় তাঁকে। তফাতের মধ্যে তাঁর আর বল-ছুড়িয়ের মধ্যে একটা মার্বেলের স্ল্যাব রাখা থাকে। আজও সেই মার্বেলে বল ছুড়ে ছুড়ে বাউন্স করানো হল তাঁকে। ছ’ফুট চার ইঞ্চির ইশান্তের জন্য? কে জানে।
যদিও এটুকু জানা যাচ্ছে ক্রিকেটমহলের ছোট অংশে এই ম্যাচ ঘিরে যতই অনন্য অনুভূতি থাক। সঙ্গা যতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ুন গলের প্রেস কনফারেন্সে। তাঁর বিদায় ঘিরে সেই ঝনঝনানিটা আদৌ নেই যা সচিন পেয়েছেন। গলের বিলবোর্ডগুলোও নেহাতই মাঠের চারপাশে। গোটা শহরে আর কোথাও দেখলাম না। অবাক লাগছে সঙ্গার শ্রীলঙ্কান স্পনসররা কোথায় গেলেন। নাকি সেই সব কোম্পানিগুলো ভোটের চাপে বিলবোর্ড ফাঁকা পায়নি?
আর কলম্বো? শ্রীলঙ্কার প্রাণকেন্দ্র যেখানে শেষ বারের মতো টেস্ট ক্যাপ পরবেন সঙ্গকারা, তারা ঘটনার মাত্র দশ দিন আগে সম্পূর্ণ নৈব্যক্তিক।
ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ক্রিকেট-সফরে আসা আগন্তুক শুনে কেউ চোখের পাতাও এ দিক-ও দিক করল না। ট্যাক্সি চালকের সঙ্গা-আলোচনায় কোনও স্পৃহাই নেই। আর ব্যাঙ্কের সামনে, পাশে মোবাইলের সিম কার্ড নেওয়ার লাইনে সবই সিঙ্গাপুর-কোরিয়ার মুখ। পর্যটকের মুখ। ক্রিকেট-পর্যটকের নয়। এখুনি সঙ্গকারা আবির্ভূত হলেও মনে হয় না ছায়াছবিটা বদলাত বলে। বহু খোঁচাখুঁচির পর কেউ কেউ বললেন, সঙ্গা গ্রেট সন্দেহ নেই। আমাদের খুব ভালবাসার, সেটাও ঠিক। কিন্তু ওর চলে যাওয়াটা টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে-তে হলে আমাদের এখানে অনেক বেশি ইমপ্যাক্ট হত।
এটাই ট্র্যাজেডি! সঙ্গা নিজে আজ সকালেও বলেছেন তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরিগুলোই একমাত্র মনে রেখে দেবেন। ওয়ান ডে-র এত সফল মহাতারকা হয়েও ঘুণাক্ষরে ওয়ান ডে বিষয়সম্পত্তির কথা তোলেননি। মুরলীর দেশের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, আধুনিক সিংহলি সমাজ ও জীবন কুমার সঙ্গকারাকে আবেগাপ্লুত বিদায়ী অভ্যর্থনা দেবে ঠিকই। কিন্তু তাঁর মাপে সেটা উপযুক্ত হয় না জোলো হয়, সেটা গলে টেস্ট ম্যাচ বৃষ্টিবিঘ্নিত থাকবে কি নার মতোই বড় প্রশ্ন।