দুরন্ত: বড় চুলের ধোনি ছিলেন সকলের চর্চায়।
খবরটা শুনে বিশ্বাসই হয়নি। চেনা নীল জার্সিতে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর দেখা যাবে না। ভারতীয় ক্রিকেটকে আইসিসি-র সব ট্রফি দেওয়া ধোনি এ ভাবে ইনস্টাগ্রামে অবসর ঘোষণা করবে, সত্যি ভাবিনি। সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। তবে এটা বলতে পারি, এই খবর অনেকের কাছে হৃদয়বিদারক।
ধোনির অবসরের দিনেই মনে পড়ল ওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনা। সেই আলাপ আবার ঝগড়ার মাধ্যমে। বিহার বনাম বাংলা ম্যাচ। ধোনি বিধ্বংসী ব্যাটিং শুরু করেছে। দ্বিতীয় নতুন বল নেওয়ার পরে প্রথম ওভারে আমার বিরুদ্ধে ১৬ রান নিল ধোনি। ওই ওভারেই আমার হাত থেকে একটি বিমার আছড়ে পড়ে। রাগে মেজাজও হারিয়ে ফেলি। ও নির্বিকার। ম্যাচ শেষে নিজেই ক্ষমা চাইল। বলল, দাদা তুমি সিনিয়র ক্রিকেটার। আমার আচরণে তোমার খারাপ যেন না লাগে। সেটাই প্রথম আলাপ।
দ্বিতীয় দেখা দলীপ ট্রফিতে। বাংলাদেশ একাদশের বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক আমি। বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ককে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হয় সেই প্রতিযোগিতায়। ধোনিকে দলে নিয়েছিলাম উইকেটকিপার ও টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। তিন দিনের ম্যাচেও দ্রুত শট খেলে বিপক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করার কৌশল মুগ্ধ করেছিল। ধোনিকে বলেছিলাম, তিন নম্বরে নামবে। তোমার দায়িত্বটা জানো তো? অবলীলায় বলে দিয়েছিল, নেমেই মারতে শুরু করব। সে ম্যাচে ৭১ বলে ৫১ রান করেছিল ধোনি। ১৭০ রান করেছিল ‘দাদি’ (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়)। ১২৩ করেছিলাম আমি। ক্রিকেট ছাড়া কিছু বুঝত না। একটি ম্যাচের পরে চার দিনের ছুটি পেয়েছিলাম সবাই। অনেকেই বাড়ি ঘুরে আসতে চেয়েছিল। ধোনি আমার কাছে অনুমতি চাইতে এল কীর্তি আজ়াদের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার জন্য। প্রশ্ন করেছিলাম, বাড়ি যাবে না? ও বলল, কীর্তি স্যরের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ তো বার বার পাব না।
যা দিয়ে গেলেন..
• অধিনায়ক হিসেবে তিনটি আইসিসি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১১ বিশ্বকাপ ও ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
• ৩৩৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ধোনি। যা সর্বোচ্চ।
• ওয়ান ডে-তে ত্রিদেশীয় অথবা চতুর্দেশীয় সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে চারটি ফাইনালে জয়। যা সর্বোচ্চ।
• ৮৪টি ওয়ান ডে ম্যাচে অপরাজিত। যা এখনও বিশ্বরেকর্ড। দ্বিতীয় স্থানে শন পোলক (৭২)।
• আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২৩টি স্টাম্পিংয়ের রেকর্ড এখনও ধোনির।
• ৯০ টেস্টে ৪৮৭৬ রান (গড় ৩৮.০৯)। সেঞ্চুরি ৬টি। সর্বোচ্চ ২২৪।
• ৩৫০টি ওয়ানডে ম্যাচে রান ১০,৭৭৩। গড় ৫০.৫৭। সেঞ্চুরি ১০।
• ৯৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রান ১৬১৭। গড় ৩৭.৬০। সর্বোচ্চ ৫৬।
• ২০০৪ সালে জীবনের প্রথম ম্যাচের প্রথম বলে রান আউট হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে শেষ ম্যাচেও রান আউট।
আরও পড়ুন: করোনাতেই কি কাড়ল ধোনির স্টাম্প, চর্চা শুরু ক্রিকেটমহলে
আরও পড়ুন: জাড্ডু থাকলে ম্যাচ করে নিতাম, সেমিফাইনালে হারের পর কোচকে বলেছিলেন মাহি
ড্রেসিংরুমে ওকে দেখে মনেই হত না কোনও চাপ অনুভব করছে। শূন্য করে ফিরলেও যে রকম নির্লিপ্ত, একশো করে ফিরলেও একই রকম। দাদি আর আমি আলোচনা করতাম, ও কি কখনও স্নায়ুর চাপ অনুভব করে না?
প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ব্যাটিং করতে নামলে বল ফেলার জায়গা পেত না কেউ। ব্যাট দিয়ে যে এমন তাণ্ডব করা যায়, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। উইকেটকিপার হিসেবে ওর আচরণ ছিল আরও মজার। উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে ইংরাজিতে কথা বলত। ও জানত কোন ব্যাটসম্যানের কোথায় সমস্যা। ধরা যাক আমার সমস্যা অফস্টাম্পে। ও বোলারকে ইংরাজিতে বলত, অফস্টাম্পে বল করার জন্য। বোলার কিন্তু বলট করত লেগস্টাম্পে। কারণ, আগের রাতেই বোলারদের সঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি করে ফেলত ও। বলে দিত, যা নির্দেশ দেব, তার উল্টোটা করবি। এ ভাবে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করার কৌশল কারও মধ্যে দেখিনি।
ধোনির মতো এত শান্ত ও মজার এক ব্যক্তিত্বকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর দেখতে পাব না ভেবেই মন ভেঙে যাচ্ছে। সবার অজান্তে সরে গেল ও। মনে পড়ে যাচ্ছে ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রীর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘ধোনি ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল।’’