ডাফিকে যেন গোলের রাস্তাটা বলে দিচ্ছেন কোচ সঞ্জয় সেন। শনিবার মোহনবাগান মাঠে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
গ্যালারির তিন প্রান্তে তিনটি ফ্যান ক্লাবের তাজা-ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা গান গাইছে। হাততালি দিতে দিতে। বাগানে ফুল দেখার আকাঙ্ক্ষার গান। দূরে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রস্তুতির বিউগল যেন তাতে সঙ্গত করে।
পৌষের শীত-সকালের ঘন কুয়াশার মধ্যেই দৌড় শুরু করে দেন কাতসুমি-জেজেরা। নতুন চেহারার ঝলমলে জার্সি গায়ে। আই লিগে নিজেদের উদ্বোধনী ম্যাচের শেষ প্রস্তুতি। পরিবেশ দেখলে মনে হয় মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টার বা রিও-তে কোনও বার্সেলোনা, ম্যান ইউ বা সাও পাওলোর অনুশীলন হচ্ছে।
বিস্ময় এবং আশা জাগে এই দৃশ্য দেখলে।
কিন্তু সকাল শেষের ছবিটা! সেটা তো একেবারেই মর্মান্তিক। বলা যায়, এ দেশের ফুটবলেরই আয়না যেন। তাঁবুর বারান্দার এক কোণে ঘুপচি মতো একটা জায়গায় নড়বড়ে কাঠের টেবিলের সামনে বসে কোচ এবং অধিনায়কদের প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলন হচ্ছে। পিছনে স্পনসর বোর্ড আছে। তবে সেটা গত বছরের ফেড কাপের! আই লিগ নেই সেখানে। অপেশাদারিত্বের নির্মম সত্য হয়ে দেখা দেয় এ সব। কর্তাদের গড়িমসি এবং আত্মতুষ্টির খেসারত দিয়ে রবীন্দ্র সরোবর থেকে ম্যাচ চলে গেছে বারাসতে। কিন্তু টিকিট কোথায়, টিকিট? হন্যে হয়ে ঘুরছেন সমর্থকরা। চাহিদা এত, বিক্রি শুরু হলেই মনে হচ্ছিল স্টেডিয়াম ভর্তি হয়ে যাবে। তবে কোথায় পাওয়া যাবে টিকিট, কেউ জানে না। কেউ বলছেন পুলিশের স্ট্যাম্প মারতে গেছে। কোনও আধা কর্তার মন্তব্য, ‘‘কাল বারাসতে গেলে পেতে পারেন। তবে শিওর বলছি না।’’
স্পনসর নেই। তা সত্ত্বেও দুর্দান্ত একটা টিম গড়েছেন বাগান কর্তারা। সঞ্জয় সেনের টিমের ফুটবলারদের ধার-ভার, শরীরী ভাষা, সেট পিস অনুশীলন বা ম্যাচ টেম্পারামেন্ট দেখতে দেখতে প্রাক্তন কিপার শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ থেকে স্বগতোক্তির মতোই বেরোয়, ‘‘আমাদের আটাত্তরের টিমের সঙ্গে তুলনা করতে পারি এই টিমকে। মনে আছে সে বার শ্যাম, সুভাষ, মানস, আকবর মিলে গোলের ফোয়ারা ছুটিয়েছিল। পুরো মরসুমে সত্তর-আশিটা গোল হয়েছিল মনে হয়।’’ পাশে বসে বিদেশ বসুর মন্তব্য, ‘‘শিবাজি, মনে আছে জায়গা পেতে কী লড়াই করতে হত আমাদের। বাগানে এ বার সেই অবস্থা হবে, দেখে নিও।’’
বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যেও দেশের সেরা টিম নিয়ে আই লিগ জয়ের লড়াইয়ে হট ফেভারিট! অদ্ভুত এক বৈপরীত্যের আবহ যেন হাজির সবুজ-মেরুনে।
আটাত্তরের কথা মনে করানো হয়নি তাঁকে। তবে বিদেশিহীন চার্চিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগে সঞ্জয় সেনকে প্রশ্ন করা হয়, গতবারের চেয়েও তো ভাল টিম হয়েছে এ বার! মানছেন? ডাকাবুকো বাগান কোচ সতর্ক এ বার। ‘‘গতবার প্রচুর গোল করেও অনেক ম্যাচ জিততে পারিনি। গোল খেয়ে গেছি। আনাস, শেহনাজ, এডুয়ার্ডোকে সে জন্যই টিমে নিয়েছি। রক্ষণ শক্তিশালী করতে। আর টিম ভাল না খারাপ সেটা তো প্রমাণ করতে হবে মাঠে।’’ বাগানের যা টিম তাতে প্রথম একাদশ বাছতে হিমশিম খেতেই হবে তেরো বছর পর বাগানকে আই লিগ দেওয়া কোচের। শনিবার সকালে অনুশীলনে টিম নিয়ে কত রকম পারমুটেশন-কম্বিনেশন যে করলেন সঞ্জয়! সনি নর্ডি আসতে আসতে জানুয়ারির মাঝামাঝি। এডুয়ার্ডোও ফিট নন। এ দিন ফিজিক্যাল ট্রেনিং করেছেন সারাক্ষণ। ফলে কাতসুমি আর ড্যারেল ডাফি—দুই বিদেশি নিয়েই আজ চার্চিল বধে নামতে হবে সঞ্জয়কে। সঙ্গে জেজে, কেন লুইস, আনাস, দেবজিতরা তো আছেনই।
চার্চিলের বিরুদ্ধে খেলার আগে সঞ্জয়ের সুবিধা এবং অসুবিধা দুই-ই আছে। সুবিধা হল, প্রতিপক্ষের প্রধান কোচ আফুসিই এখনও আসেননি। কোনও বিদেশি খেলবেন না বিপক্ষে। মাত্র পাঁচ দিনের অনুশীলন করে এসেছে গোয়ার ক্লাব। আর অসুবিধা হল, টিমটা সঞ্জয়ের একেবারেই অচেনা। তা ছাড়াও পোড়-খাওয়া ডেঞ্জিল ফ্র্যাঙ্কো, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা, রোয়িলসনস, সুরাবুদ্দিন, আদিলের মতো ফুটবলার আছে চার্চিলে। যাঁরা নিজেদের প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপাবেই। সেই আশঙ্কা থেকেই বাগান কোচের মুখ থেকে বেরোয়, ‘‘চেনা খেলোয়াড় থাকলে একটা স্ট্র্যাটেজি করা যায়। কিন্তু চার্চিলে যারা আছে, তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমার তো কোনও ধারণাই নেই।’’
গোয়ার প্রো লিগ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরের শেষ দিন। তার পর ক্লিফোর্ডদের অনুশীলন শুরু হয়েছে। এখনও পুরো কিট-ই পাননি ফুটবলাররা। কোনওমতে দু’সেট খেলার জার্সি তৈরি করিয়ে নিয়ে এসেছেন বর্তমান কোচ আলফ্রেড। এত দুরবস্থা! সেই ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা হয়েও চার্চিলের অস্থায়ী কোচের গলায় কিন্তু মাঠে নামার আগে আশা। ‘‘গোয়ার ভূমিপুত্র আর জুনিয়রদের ছোট করে দেখলে ভুল হবে। বিদেশি নেই তো কী? ওদের উপর পূর্ণ আস্থা রাখছি।’’কোচের পাশে বসে বাগান অধিনায়ক কাতসুমি বলছিলেন, ‘‘ভাল খেলার কথা আমরা এ বার বলব না। বলব ট্রফির কথা। খারাপ খেলেও ট্রফি জিতলে সমর্থকরা খুশি হবেন না, তা তো নয়। তাই ট্রফিটা চাই।’’
ট্রফি জয়ের সেই দৌড় আজ শুরু করছে বাগান। তবে এমন একটা মাঠে যেখানে বহু দিন খেলেননি তাঁরা। খাতায়-কলমে ঝকঝকে বাগান এ- বারের দৌড়টা জয় দিয়ে শুরু করতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।