উৎসব: জয়ের পর উল্লাস লিংডো ও কামোর। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মোহনবাগান ৩
রেলওয়ে এফসি ০
বিদ্যুৎপৃষ্ট রেলওয়ে এফসি!
বিদ্যুতের নাম চেস্টারপল লিংডো!
শুক্রবার বিকেলে কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে মোহনবাগান বনাম রেলওয়ে এফসি ম্যাচ চলাকালীন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল। বৃষ্টিতে ম্যাচ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কায় যখন আতঙ্কিত সবুজ-মেরুন সমর্থকরা, তখনই লিংডোর ডান পায়ের বাঁক খাওয়ানো শট জড়িয়ে যায় রেলওয়ে এফসি-র জালে। আর তার পরেই বিদ্যুতের ঝলক। ইউসেইন বোল্টের ভঙ্গিতে সতীর্থদের নিয়ে উৎসবে মেতে উঠলেন মেঘের দেশ মেঘালয়ের বছর উনিশের যুবক। গ্যালারি মাতিয়ে দিলেন ‘ড্যাব ড্যান্স’-এ।
ছ’মাস আগে সবুজ-মেরুন শিবিরে অন্ধকার নেমে এসেছিল এই লিংডো-র জন্যই! তিনি তখন চার্চিল ব্রাদার্সে। গোয়ার তিলক ময়দানে তাঁর গোলেই আই লিগের খেতাবি দৌড়ে পিছিয়ে পড়া শুরু হয়েছিল সনি নর্দে-দের। এ বার লিংডোর শিকার রেলওয়ে এফসি।
গোল করলে বোল্টের ভঙ্গিতে উৎসব করেন লিংডো। তাঁর প্রিয় ফুটবলারের নাম অ্যালেক্সিস স্যাঞ্চেজ। অথচ, মাথায় আর্তুরো ভিদালের মতো চুলের ছাঁট। রহস্যটা কী? হাসতে হাসতে লিংডো বললেন, ‘‘ভিদালের হেয়ার স্টাইলটাই শুধু আমার ভাল লাগে। কিন্তু আদর্শ স্যাঞ্চেজ।’’ আর বোল্ট? ‘‘প্রচণ্ড গতিতে দৌড় শেষ করে বোল্টের ওই সেলিব্রেশন অনবদ্য।’’ একই রকম ভাবে চমকপ্রদ লিংডোর উত্থানের কাহিনিও।
শিলং থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বে একটি গ্রামে জন্ম লিংডোর। মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। মা সামান্য সাফাইকর্মী। তাঁর একার রোজগারেই কোনও মতে সংসার চলত। প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যেও অবশ্য ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছাড়েননি লিংডো। গ্রাম ছেড়ে শিলংয়ে চলে যান। স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সাই)-এর ট্রায়ালে নেমেই নজর কেড়ে নিয়েছিলেন নির্বাচকদের। তবে মোহনবাগানের নতুন তারকার উত্থানের নেপথ্যে লাল-হলুদ অ্যাকাডেমির কোচ রঞ্জন চৌধুরী!
পুণে এফসি অ্যাকাডেমির দায়িত্বে তখন রঞ্জন। প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলারের সন্ধানে মেঘালয়ের গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন তিনি। রঞ্জনের কথায়, ‘‘শিলং থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে প্রথম লিংডোকে দেখি। ছোটখাটো চেহারা। কিন্তু বল নিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়তে পারে। লিংডোকে নিয়ে যাই পুণে এফসি-র অ্যাকাডেমিতে।’’ রঞ্জন আরও জানালেন, ১০০ মিটার ১১.৫ সেকেন্ডে শেষ করেন লিংডো!
রেলওয়ে এফসি-র বিরুদ্ধে লিংডো এ দিন শুধু গোলই করেননি, মোহনবাগানের আক্রমণে নেতৃত্বও দিয়েছেন। প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষের রক্ষণাত্মক স্ট্র্যাটেজির সামনে বারবার আটকে যান কামো বায়ো, আনসুমানা ক্রোমা-রা। এমনকী, ৪৩ মিনিটে রেল দলের অমিত সামন্ত লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও ছবিটা বদলায়নি। দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগান বদলে গেল লিংডোর সৌজন্যে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার হাতে নিয়ে লিংডো বললেন, ‘‘আমার গোলে দল জেতায় বেশি আনন্দ হচ্ছে। আমার স্বপ্ন দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করা।’’ কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী বললেন, ‘‘প্রতিপক্ষ যখন অতিরক্ষণাত্মক খেলে, তখন গোল করা কঠিন হয়ে যায়। এই কারণেই প্রথমার্ধে আমরা এগিয়ে যেতে পারিনি।’’
লিংডোকে নিয়ে যখন সবুজ-মেরুন সমর্থকরা উৎসবে মত্ত, তখন নীরবে মাঠ ছাড়ছিলেন আর এক নায়ক শিল্টন ডি’সিলভা। মোহনবাগানের এই স্ট্রাইকারের জীবনেও একটা সময় অন্ধকার নেমে এসেছিল। হাঁটুতে চোট পেয়ে প্রায় চার বছর মাঠের চলে গিয়েছিলেন তিনি। সবুজ-মেরুন জার্সিতে এই মরসুমে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটালেন শিল্টন। পরপর দু’টো ম্যাচেই পরিবর্ত হিসেবে নেমে গোল করলেন। তিনি বললেন, ‘‘আমার কাছে এটা ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। চোটের জন্য আমার ফুটবলজীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। অনেক লড়াই করে মাঠে ফিরেছি। এ বার সফল হতেই হবে।’’
শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন কামো বায়ো-ও। সবুজ-মেরুন জার্সিতে অভিষেক ম্যাচে গোল না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। চব্বিশ ঘণ্টা আগে জন্মদিনে কোনও উৎসব না করে শপথ নিয়েছিলেন রেল দলের বিরুদ্ধে গোল করার। এ দিন ৮১ মিনিটে করা দুরন্ত গোল উৎসর্গ করলেন সমর্থকদের।
ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান দুই দলের দু’ম্যাচে ছয় পয়েন্ট। তবে গোল পার্থক্যে উইলিস প্লাজা-দের টপকে শীর্ষ স্থানে উঠে এলেন কামো-রা।
মোহনবাগান: শিবিনরাজ কুনিইল, অরিজিৎ বাগুই, কিংশুক দেবনাথ, এজে কিংসলে, রিকি লালানমাওমা, চেস্টারপল লিংডো, সুরচন্দ্র সিংহ (নরহরি শ্রেষ্ঠ), রেনিয়ার ফার্নান্দেজ, নিখিল কদম (আজহারউদ্দিন মল্লিক), আনসুমানা ক্রোমা ও কামো বায়ো।