গেম চেঞ্জার। শনিবারের ডার্বি কী নিয়ে অপেক্ষা করছে সনি, র্যান্টির জন্য? ছবি উৎপল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মানে এমন এক ম্যাচ যেখানে দু’টো দলের ফর্ম-বুক দিয়ে কিছু যায়-আসে না। দিনের দিনে যারা স্নায়ু ধরে রাখতে পারবে, যে দল সুযোগগুলো ঠিকঠাক নিতে পারবে ম্যাচটা তার।
আজকের ডার্বিতে দল হিসেবে মোহনবাগান অবশ্যই খুব ভাল। ফরোয়ার্ড লাইন যেমন শক্তিশালী তেমনই রিজার্ভ বেঞ্চেও খেলা ঘোরানোর লোক আছে।
কিন্তু তা বলে ইস্টবেঙ্গলকে পিছিয়ে রাখব না। এই ম্যাচে আমার কোনও ফেভারিট নেই। দুটো দলের সমান সুযোগ আছে জেতার। হতে পারে মোহনবাগান হয়তো চারটে সুযোগ তৈরি করবে, ইস্টবেঙ্গল তিনটে। কিন্তু যার কনভার্সন রেট বেশি হবে, ম্যাচ তার।
প্রশ্ন একটাই, কোন দল আজ বড় ম্যাচের চাপ সামলাতে পারবে?
পিছন থেকে শুরু করলে বলতে হবে, দুটো দলেরই ডিফেন্স নিয়ে জিজ্ঞাসা চিহ্ন থেকে গিয়েছে। মোহনবাগানের লুসিয়ানো সাব্রোসা-কিংশুক দেবনাথ জুটি যেমন গ্রাউন্ডে ভাল, কিন্ত শূন্যে একটু দুর্বল। এরিয়াল বলের বিরুদ্ধে সমস্যা হলেও হতে পারে ওদের। ডিফেন্স থেকে বেশির ভাগ দেখছি লম্বা ক্লিয়ারেন্স হচ্ছে। ব্যাকলাইনে খেললে এখন শুধু বল উড়িয়ে দিলে হয় না। পিছন থেকেই বিল্ড-আপ শুরু হয় এখন।
ইস্টবেঙ্গলে বেলো-অর্ণব জুটিটা ভাল। কিন্তু সেই আইএসএল থেকে টানা খেলছে অর্ণব। একটু হলেও তো ধকল হবে। বেলোকে আমিও কোচিং করিয়েছি। ও আদর্শ টিম প্লেয়ার। ওকে যদি বুঝিয়ে দেওয়া হয়— দেখ, আজ তোকে এই প্লেয়ারটাকে মার্ক করতে হবে, ও সেটাই করে। সমস্যা হল গতি কম। একটু অনুমানক্ষমতার অভাব আছে।
সেন্টার ব্যাকে একটু সমস্যা থাকলেও দুটো দলেরই সাই়ডব্যাকরা আবার খুব ভাল। ক্রমাগত উপর-নীচ করতে পারে।
বর্তমান ফুটবলে সাইডব্যাক পজিশনটা বদলে হয়ে গিয়েছে উইং ব্যাক। আগে এটা ছিল ডিফেন্সিভ পজিশন। এখন হয়ে উঠেছে উপর-নীচের মধ্যে যোগসূত্রের একটা পজিশন। গোটা ম্যাচে প্রচণ্ড খাটাখাটুনির প্রবণতা না থাকলে এই পজিশনে ভাল খেলা অসম্ভব। মোহনবাগানে প্রীতম কোটাল, ধনচন্দ্র আর ইস্টবেঙ্গলে রাহুল ভেকে, রবার্ট— সবাই ক্রস দিতে পারে। দম আছে। অসামান্য ওয়ার্ক রেট।
গত ক’দিন ডার্বি নিয়ে যাদের সঙ্গেই আলোচনা করছি, সবাই জিজ্ঞেস করছে, ডু ডং বনাম সনি নর্ডির লড়াইয়ে কে এগিয়ে?
দুটো ফুটবলারের স্টাইল কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ইস্টবেঙ্গলের ডং হচ্ছে বল প্লেয়ার। যে দু’-তিন জনের মধ্যে দিয়েও আঠার মতো বল নিয়ে এগোতে পারে। ছোট জায়গায় ড্রিবল করে সাপোর্টে লোক আনতে পারে। আবার নিজে উইথ দ্য বল গতি তুলতে পারে। ডেড-বল সিচুয়েশনেও দারুণ।
মোহনবাগানের সনি আবার প্রকৃত উইং ম্যান। আউটসাইড ডজ যার ভাল। খেলাটা ছড়াতে পারে। সব সময় সাইডব্যাকদের নিশানায় রাখে। মাঠের ধার দিয়ে খেলতে বেশি ভালবাসে। বুদ্ধি দিয়ে ম্যাচ রিড করে।
ডংয়ের আবার একটা সমস্যা, ওর শক্তি কম। যদি আজ মোহনবাগানের স্ট্র্যাটেজি হয় ফিজিক্যাল ফুটবল, সে ক্ষেত্রে ডংয়ের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ডং সনি—দু’জনেরই ক্ষমতা আছে শিরোনাম ছিনিয়ে নেওয়ার।
দু’দলের মাঝমাঠে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেল। ইস্টবেঙ্গলে যেমন মেহতাব ডার্বি খেলে খেলে-খেলে অভ্যস্ত। খাবরা খাটতে পারে। মোহনবাগানে সেখানে প্রণয় হালদারের এটাই প্রথম ডার্বি। ঠিক এর আগে সালগাওকর ম্যাচে ওর খেলা দেখে আমার বেশ ভাল লেগেছিল। পাস বাড়াতে পারে। ঠান্ডা মাথা। একজন তরুণ প্লেয়ারের যে প্রচণ্ড জেতার খিদে থাকে, সেটাও আছে।
কর্নেল গ্লেন থাকায় মোহনবাগানের ফরোয়ার্ড লাইনকে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। গ্লেন হচ্ছে ‘গোল-পোচার’। যে হয়তো খুব বেশি খাটবে না, কিন্তু স্ট্রাইকিং জোনে বল পেলে ঠিক জালে ঢুকিয়ে দেবে।
আবার ইস্টবেঙ্গলে র্যান্টি হচ্ছে আদর্শ বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। যতই ওকে বুড়ো বলা হোক, কেউ খারাপ হলে আই লিগে দুশোর বেশি গোল করতে পারে না। বড় ম্যাচ পরিস্থিতিতে ওর থেকে ভাল স্ট্রাইকার খুব কম আছে। বক্সের আশপাশে র্যান্টি বল পাওয়া মানেই দলের জন্য কিছু না কিছু সুযোগ তৈরি করবেই।
তবে এই ম্যাচে আরও যেটা ভাল লাগছে আমার— শুধু বিদেশিই নয়। বলবন্ত, বিকাশ জাইরুর মতো দুর্দান্ত সমস্ত ভারতীয় প্রতিভাও খেলবে দু’দলে। আবার অনেক বাঙালি ফুটবলারও আছে।
ডার্বির জেতার নির্যাস দিতে হলে তিনটে জিনিস খুব দরকার।
এক, দলের মানসিকতা।
দুই, ফরোয়ার্ডরা কতটা লোড নিচ্ছে। স্ট্রাইকার বলে উপরে গিয়ে বসে থাকলাম, ও রকম করলে হবে না। তাকে ট্র্যাক ব্যাকও করতে হবে। সব সময় ডিফেন্সকে সাহায্য করবে।
তিন, গ্যালারি ভুলে যেতে হবে। সমর্থকরা সব সময় পাশে থাকবেই। কিন্তু ওদের আবেগকে নিজের ঘাড়ে চাপে বদলে ফেললেই মুশকিল।
আমি নিজে ডার্বিতে কোচিং করিয়েছি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, দু’দলের হয়েই স্ট্র্যাটেজি কষেছি। অনেকে ভাবে, ডার্বি মানেই হয়তো ম্যাচের আগে কোচকে বড় বড় কথা বলতে হবে ড্রেসিংরুমে ছেলেদের সামনে। আমি কিন্তু অন্য পদ্ধতি মেনে চলতাম। আমার টিম-টক হত, ডার্বি ম্যাচের পরে কী হতে পারে!
ফুটবলারদের বলতাম, খুব সাবধানে এই ম্যাচটা খেলবে। এমন হতে পারে তুমি একশো শতাংশ দিলে না, ম্যাচের পরে সমস্ত দায় তোমাকে নিতে হল। এটা এমন একটা ম্যাচ যা নায়ক তৈরি করে, আবার কেরিয়ারও শেষ করে দিতে পারে।
আজ সঞ্জয় আর বিশুর দলের জন্যও সেই টোটকাই থাকল আমার।