ত্রয়ী: গোলের পরে মোহনবাগানের পাপাকে (মাঝে) নিয়ে উল্লাস দুই সতীর্থ বেইতিয়া ও নওরেমের (ডান দিকে)। বৃহস্পতিবার কল্যাণীতে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
কিবু-বাহিনীর অশ্বমেধের ঘোড়ার হঠাৎই যাত্রাভঙ্গ।
টানা সাত ম্যাচ জেতার পরে গতবারের চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সিটি এফসির কাছে আটকে গেল মোহনবাগান। তবে তাতে নাগাড়ে তেরো ম্যাচ জিতে আই লিগের রেকর্ড করা জোসেবা বেইতিয়াদের বড় কোনও ক্ষতি হল না। এ জন্য ট্রফি জয়ের উৎসব হয়তো পিছিয়ে যেতে পারে কয়েক দিন। লিগ টেবলের পরিস্থিতি যা, তাতে সহজ অঙ্ক হল, বাকি পাঁচ ম্যাচে পাঁচ পয়েন্ট দরকার পালতোলা নৌকার সওয়ারিদের। অন্য আর একটা সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। তা হল, সোমবার ইস্টবেঙ্গল বনাম রিয়াল কাশ্মীর ম্যাচে কাশ্মীর পয়েন্ট নষ্ট করলেই সুবিধা হয়ে যাবে ১৩০ বছরের ক্লাবের। সে ক্ষেত্রে ১০ মার্চ আইজল এফসি-র বিরুদ্ধে এই মাঠে জিতলেই গোষ্ঠ পাল সরণির তাঁবুতে ঢুকে যাবে ট্রফি।
কোচ, ফুটবলার, কর্তাদের মতো এ সব অঙ্ক ঠোঁটের ডগায় থাকে সমর্থকদের। বিশেষ করে বিভিন্ন ফ্যান ক্লাবের সোশ্যাল মিডিয়ার নানা পোস্টের সৌজন্যে। সে জন্যই সম্ভবত মরসুমের সবচেয়ে খারাপ ম্যাচ খেলেও যখন ফ্রান গঞ্জালেস, জোসেবা বেইতিয়ারা গ্যালারিকে অভিবাদন জানাতে এগিয়ে গেলেন, তখন তাঁদের সঙ্গে ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’ দিলেন হাজার পনেরো সমর্থক। ম্যাচের পরে মোহনবাগান কোচ কিবু ভিকুনা বলে দিলেন, ‘‘আমাদের চেয়ে চেন্নাই অনেক ভাল খেলেছে। বিশেষ করে প্রথমার্ধে।’’ আর চেন্নাই কোচ আকবর নওয়াজ দাবি করলেন, ‘‘ম্যাচটা আমরা জিততে পারতাম।’’
উপচে পড়া গ্যালারি। বনগাঁ থেকে বাগুইআঁটি, বেলুড় থেকে হালিশহর— অসংখ্য ফেস্টুন আর সবুজ-মেরুন পতাকা নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে হাজির হয়েছিলেন সমর্থকেরা। ফেডারেশনের তরফ থেকে মাসের সেরা কোচ ও ফুটবলারের ট্রফি তুলে দেওয়া হল কিবু ও বেইতিয়ার হাতে।
কিন্তু চেন্নাইয়ের দৌরাত্ম্যে সেই উৎসব ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই স্তব্ধ হয়ে গেল। আকবরের দল একের পর এক গোলের সহজ সুযোগ নষ্ট করছিল আর উদ্বেগ বাড়ছিল সবুজ-মেরুন সমর্থকদের। চেন্নাইয়ের কোচের দুর্দান্ত রণনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ফ্রান মোরন্তেরা। একটা সময় মনে হচ্ছিল, যে কোনও মুহূর্তে গোল খেয়ে যাবে মোহনবাগান। চেন্নাইয়ের আদোলফো মিরান্দার শট বাঁচালেন সবুজ-মেরুনের গোলকিপার শঙ্কর রায়। প্রথমার্ধে আরও একবার গোলের সহজ সুযোগ পেয়েছিলেন চেন্নাইয়ের ওই স্পেনীয় ফুটবলার। একের বিরুদ্ধে এক অবস্থায় শঙ্করকে পেয়েও বল বাইরে মারলেন তিনি। শুধু তাই নয়, চেন্নাইয়ের জকসন ধাসের শট মোহনবাগান পোস্ট কাঁপিয়ে ফিরল। প্রথমার্ধে শুধু একবার গোলের সুয়োগ পেয়েছিলেন বেইতিয়া। তার শটও বিপক্ষের ক্রসবারে লেগে ফেরে।
চেন্নাই কোচ আকবরের রণনীতি ছিল সহজ। রক্ষণ ও মাঝমাঠ জমাট করে পাল্টা আক্রমণে গোল তুলে নেওয়ার চেষ্টা। সঙ্গে মোহনবাগানের দুই সেরা অস্ত্র পাপা বাবাকর জিয়োহারা এবং বেইতিয়াকে পালা করে মার্কিং করা। ম্যাচের আগেই আকবর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তাঁর রক্ষণ যদি কেউ ভাঙতে পারেন, তিনি লা লিগায় দাপিয়ে খেলে আসা পাপা-ই। সেনেগালজাত স্ট্রাইকার বল ধরলেই তাঁকে চক্রব্যূহে আটকে ফেলছিল চেন্নাইয়ের রক্ষণ। কিন্তু আতলেতিকো দে মাদ্রিদের মতো দলের বিরুদ্ধে যিনি গোল করে এসেছেন, তাঁকে থামানো যাবে কত ক্ষণ? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হতেই মোহনবাগান স্ট্রাইকার স্বমহিমায়। ফ্রান মোরান্তের পা থেকে বল পেয়েছিলেন নংদাম্বা নওরেম। বল ধরেই তিনি চেন্নাইয়ের রোহিতকে ফাঁকি দিয়ে তা বাড়ান পাপাকে। মাটি ঘেঁষা শটে গোল করে যান তিনি। টানা আট ম্যাচে নয় গোল, যে রেকর্ড সাম্প্রতিক কালে ভারতে খেলা কোনও বিদেশি স্ট্রাইকারের নেই। বিরতির ঠিক মুখে পাপার গোলেই গ্যালারি যেন প্রাণ পেল। কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হল মাত্র ২২ মিনিট। বিরতির কিছু ক্ষণ পর জকসনের পাস থেকে গোল করে গেলেন মোহনবাগানেরই প্রাক্তনী ইউসা কাতসুমি। ১-১ হয়ে যাওয়ার পরে রক্ষণ আরও জমাট করে দিলেন চেন্নাই কোচ। কিবু-বাহিনী তখন ঝাপটা দিতে শুরু করল। কিন্তু পাপাদের সব লড়াই শেষ হয়ে যাচ্ছিল চেন্নাই রক্ষণে এসে। বেইতিয়ার দুর্দান্ত হেড বাঁচালেন তাঁরই স্বদেশীয় গোলকিপার চেন্নাইয়ের গার্সিয়া সান্তানা। সুযোগ নষ্ট করলেন পাপা-ও। কিবু অবশ্য বললেন, ‘‘পাপা মেসি নয়। ও বক্স স্ট্রাইকার। ওর কাজ গোল করা। সেটাই পাপা করছে।’’ মোহনবাগানের একটি ক্ষতি অবশ্য এ দিন হল। কার্ড দেখায় পরের আইজল ম্যাচে খেলতে পারবেন না ফ্রান মোরান্তে।
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, আশুতোষ মেহতা, ফ্রান মোরান্তে, ফ্রান গঞ্জালেস, গুরজিন্দর কুমার, নংদোম্বা নওরেম, শেখ সাহিল, জোসেবা বেইতিয়া, শিল্টন ডি সিলভা (ব্রিটো পি এম), সুহের ভি পি (শুভ ঘোষ), পাপা বাবাকর জিয়োহারা।
চেন্নাই সিটি: গার্সিয়া সান্তানা, অজিথকুমার, রবের্তো বি, মাসুর শরিফ, রহিত মির্জা (জিষ্ণু বালাকৃষ্ণন), প্রভিত্ব রাজু (চার্লস আনন্দরাজ), জকসন ধাসা (সুহেল পাসা), শ্রীরাম বি, কাতসুমি ইউসা, আদোলফো মিরান্ডা, বিজয় এন।