তাসমানের কোন পারে আজ কাপ

ক্লার্কের ভাগ্য কাদম্বিনীর চেয়েও খারাপ

কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল সে মরে নাই! মাইকেল ক্লার্ক ওয়ান ডে ক্রিকেট হইতে অবসর লইয়াও প্রমাণ করিতে পারিলেন না তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর সর্বদা যে দেশকে রাখিতেন! ইভেন্টের ইতিহাসে প্রাক্ বিশ্বকাপ ফাইনাল সর্বকালের সবচেয়ে নাটকীয় ঘোষণার পর এমসিজি মিডিয়া কনফারেন্স রুম স্তব্ধই হয়ে যায় সাময়িক। সবাই জানত ক্লার্ক হয় অবসর নিতে বাধ্য হবেন। বা বিশ্বকাপের পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আনন্দবাজার খেলার পাতার পাঠকেরা অন্তত জানেন, অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি মুকুটের ওপর একটা বড় সাইক্লোন বেশ কিছু দিন জমা হচ্ছিল।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

কাপ নিশ্চিত করতে স্মিথদের নেটে গিলক্রিস্ট।

কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল সে মরে নাই!

Advertisement

মাইকেল ক্লার্ক ওয়ান ডে ক্রিকেট হইতে অবসর লইয়াও প্রমাণ করিতে পারিলেন না তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর সর্বদা যে দেশকে রাখিতেন!

ইভেন্টের ইতিহাসে প্রাক্ বিশ্বকাপ ফাইনাল সর্বকালের সবচেয়ে নাটকীয় ঘোষণার পর এমসিজি মিডিয়া কনফারেন্স রুম স্তব্ধই হয়ে যায় সাময়িক। সবাই জানত ক্লার্ক হয় অবসর নিতে বাধ্য হবেন। বা বিশ্বকাপের পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার খেলার পাতার পাঠকেরা অন্তত জানেন, অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি মুকুটের ওপর একটা বড় সাইক্লোন বেশ কিছু দিন জমা হচ্ছিল। হয় ক্লার্ককে কিছু একটা করতে হত। নয়তো রড মার্শের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচক কমিটির।

কিন্তু কেউ ভাবেনি দাঁড়িটা দূরে দেখতে পেয়ে ফাইনালের আগেই যে ক্লার্ক আচমকা ক্রিকেটীয় আত্মহননের রাস্তা বেছে নেবেন। এক-এক সময় তাঁকে শোকার্ত লাগছিল বললেও কম বলা হয়। জানালেন অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে ভারতের ম্যাচ খেলে ওঠার পর। রাতে বাড়ি পৌঁছন মধ্যরাতেরও পরে। স্ত্রী কাইলি ততক্ষণে শুতে চলে গিয়েছেন। তাঁকে তখনই জানান কী করতে যাচ্ছেন। আর টিমমেটদের জানান মিডিয়ার সামনে আসার দশ মিনিট আগে। “ওরা তো এক-এক জন শক্ড হয়ে গেল। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ভেবে দেখলাম পরের বিশ্বকাপে আমি আর খেলতে পারব না। তাই যদি হয়, নতুন ক্যাপ্টেনকে এখন থেকে সময় দেওয়াই উচিত,” বললেন ক্লার্ক।

এ বার এক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনার শরীর আর তত দিন দেবে না বলেই কি ভাবলেন আমার সরে যাওয়া উচিত? ক্লার্ক সেই ফিটনেস তত্ত্বটা দ্রুতই খারিজ করে দিলেন। সত্যি তো ফিটনেস কারণ নয়। তিনি চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন নির্বাচক আর অজি মিডিয়ার মিলিত দম বন্ধ করা চাপে। ক্লার্ক তাই প্রশ্নকর্তাকে একটা আগুনে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, “ফিটনেস সমস্যা তো আমার সতেরো বছর বয়স থেকেই ছিল। তা নিয়েই তো আড়াইশোর কাছাকাছি ওয়ান ডে ম্যাচ খেলে ফেললাম।” মর্মার্থ— তোরা আমাকে ও দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারবি না যেটা চাইছিস।

ক্লার্ক টানা দুটো নকআউট ম্যাচে বিশ্রী আউট হয়ে আরও কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন সবাই জানত। তাঁর ভবিতব্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু কেউ ভাবেনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ‘নাটা মল্লিক’দের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি নিজেই যে দড়ি ধরে ঝুলে পড়বেন। এই অপূর্ব টাইমিংয়ে অধিনায়কের লাভ হল এই যে, পুরো গণ সহানুভূতিটাই নিজের দিকে নিয়ে নিলেন। রেডিও প্রোগ্রামে। টিভি অনুষ্ঠানে। টুইটার ট্রেন্ডে। ফেসবুকে সর্বত্র— তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা। এই ক’দিন আগেও প্রাক্তন যে ক্রিকেটাররা তাঁর মুণ্ডপাত করেছেন, তাঁরা এমন ভাবে এ দিন প্রশংসা করেছেন যেন আগের বক্তব্যগুলো পয়লা এপ্রিল টাইপ রসিকতা ছিল।

অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার শীর্ষস্থানীয় জনাকয়েকের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু মনে হল ক্লার্কের টাইমিংয়ে তাঁরা তীব্র অখুশি। এঁদের মনোভাব হল: সেই পুরো মনোযোগটা নিজের দিকে টেনে নিল! এটাই ওর সমস্যা। মাইকেল ক্লার্কের জীবনে আমি ছাড়া কিছু নেই। আমরা বলে কিছু নেই। ফাইনালের পুরো ফোকাসটাই ও খেলা থেকে আবেগে সরিয়ে নিল। এই ঘোষণাটা কি ফাইনালের পরে করা যেত না? এক দিনের তো ব্যাপার ছিল। প্রাক্তন দুঁদে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক বর্তমানে ক্রিকেট প্রশাসনে যুক্ত ম্যালকম কন তো বলেই ফেললেন, “কাল যদি অস্ট্রেলিয়া হারে তা হলে কী ভাবে সেই হারের ব্যাখ্যা হবে সেটা দারুণ ইন্টারেস্টিং।” মানে ঘুরিয়ে বলা, অস্ট্রেলিয়া হারলে ক্লার্কের সিদ্ধান্তের টাইমিংয়ের ওপর দোষ পড়বে।

মাইকেল ক্লার্কের তাই উভয়সঙ্কট। তাঁর দায়িত্ব ছেড়েও কাঁটার মুকুট। দায়িত্বে থেকেও কাঁটার। অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড এই চিরবৈরিতা নিয়ে যে সকাল থেকে নিরন্তর আলোচনা আর আকচাআকচি চলছিল, সেটাকে ক্লার্ক সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছেন। এখন আর কেউ জিজ্ঞেস করছে না, অস্ট্রেলিয়া আবার বিশ্বকাপ জিতবে তো? প্রশ্নটা বদলে দাঁড়াচ্ছে, ক্লার্ক কাপ হাতে শেষ করতে পারবেন তো?

সকালে এমসিজির বাইরে দেখি শ’দুয়েক লোক জমে গিয়েছে। একটু অবাকই লাগল এই ভিড়টা যারা এত দিন টুর্নামেন্টে উপভোগ করেছে, তারা তো ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে যে যার নিজের শহরে। তা হলে এরা কারা? না এরা এক দঙ্গল নিউজিল্যান্ড সমর্থক। তাসমান সমুদ্র উজিয়ে ফাইনাল জিততে এসেছে। আর তাদের মনোবল বাড়াতে সাতসকালে ১৮-১৯ ডিগ্রির মধ্যে কিছু ভারতীয়। সাদা-কালো রঙের কয়েকটা ফ্ল্যাগ বানানো রয়েছে। যেগুলো তারা প্রবল হাততালির মধ্যে বারবার একসঙ্গে ওড়াচ্ছে। লেখা— গিভ দেম আ টেস্ট অব কিউয়ি।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

নিউজিল্যান্ডের নামী রেডিও সাংবাদিক ইতিমধ্যে বলতে শুরু করলেন, “অস্ট্রেলিয়া কেমন গোয়েবলসীয় কায়দায় ব্রেন্ডন ম্যাকালামের টিমের বিরুদ্ধে অনবরত মিথ্যে প্রোপাগান্ডা করে চলেছে দেখেছেন! বারবার বলা হচ্ছে এমসিজির মতো বড় মাঠে ওদের খেলার অভিজ্ঞতা নেই। মাঠে এত সব নতুন অ্যাঙ্গল ওরা ধাতস্থ হতে পারবে না। তখনই তো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। ফাইনাল কী জিতবে!”

কিন্তু ক্লার্ক-ঘোষণা পরবর্তী এমন একটা মানবিক দৃষ্টিকোণ এসে হাজির হয়েছে যে, বৈরিতা আর তথাকথিত মিথ্যে প্রচার ধুয়েমুছে সাফ। বরং নিউজিল্যান্ডের দিক থেকে মানবিক দৃষ্টিকোণ হিসেবে হাজির হচ্ছেন জীবন-মৃত্যুর সীমান্তে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়সী।

তিনি মার্টিন ক্রো। রোববার এমসিজিতে জীবনের শেষ ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে হাজির হচ্ছেন। ক্রোর শরীর মাঝে এত খারাপ হয়ে গেছিল যে পুরো বিশ্বকাপটা দেখে যেতে পারবেন কি না প্রশ্ন ছিল। সেই তিনি তাসমান সমুদ্র পেরিয়ে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সদর দফতরে শেষ বারের মতো হাজির হবেন। রিচার্ড হ্যাডলি-স্টিভ ওয়-তেন্ডুলকরদের সঙ্গে ফাইনাল দেখতে বসবেন ভাবাই যায় না! শনিবার ক্রোকে ফোনে ধরলে তিনি ক্লার্কের সিদ্ধান্ত ওঁর দলকে প্রেরণা জোগাবে বলেই রেখে দিলেন।

তিনি হয়তো জানেন না তাঁর নিজের মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত যে ম্যাকালামদের কত টগবগে মোটিভেশন জোগাবে। নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের এমনিতে একটা মোটিভেশন কাজ করে আসছিল যে, বিশ্বকাপ জিতে ক্রিকেটকে বাড়তি সম্ভ্রমের জায়গায় নিয়ে যাও। নিউজিল্যান্ড স্পোর্টস বলতে বিদেশে যে অল ব্ল্যাক্স রাগবি টিম বলে, তার কাছাকাছি কোথাও দেশের ক্রিকেট টিমকে নিয়ে যাও!

একটা ফাইনালের মেগা ফাইনালে চিরস্মরণীয় হতে আর কী চাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement