লুকা নামেই কি গ্র্যান্ড স্ল্যামে নাদালের ব্যথা? রবি-রাতের পরে লুকা নামটায় চোদ্দো গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়নের অরুচি ধরলেও বোধহয় অবাক হওয়ার নেই টেনিসমহলের!
চার বছর আগে উইম্বলডনের দ্বিতীয় রাউন্ডে বাঁ-হাতি স্প্যানিশ মহাতারকার ঘাসের কোর্টের গ্র্যান্ড স্ল্যামে তৃতীয় বার খেতাব জয়ের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছিলেন কোনও এক লুকা রসোল। যে চেক জায়ান্ট কিলার সেই সময় ছিলেন বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম একশোরও বাইরে।
চার বছর পরে যুক্তরাষ্ট্র ওপেনের চতুর্থ রাউন্ডে রাফা নাদালের মার্কিন মুলুকে তৃতীয় বার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেল ফরাসি লুকা— লুকা পুইয়ের কাছে হেরে। যার পরে টুর্নামেন্টের সরকারি ওয়েবসাইটে বছর বাইশের ফরাসি তরুণের উচ্ছ্বাসের ব্যাপকতা বোঝাতে প্রতিবেদনের হেডিং করা হয়েছে ‘উই, পুই!’ যার ইংরেজি তর্জমা— ‘ইয়েস, পুই’।
লুকা রসোলের কাছে হারের চেয়েও গতকাল লুকা পুইয়ের বিরুদ্ধে হার চিরলড়াকু নাদালের কাছে বেশি বেদনার। কেননা ২০১৪-এ শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা নাদাল অনেক দিন বাদে ইউনাইটেড স্টেটস টেনিস অ্যাসোসিয়েশন বা ইউএসটিএ-র হার্ডকোর্টে ক্রমেই নিজের পুরনো খেলাটা ফিরে পাচ্ছিলেন। যিনি এ বছর চোটের জন্য সেই মে মাসে ফরাসি ওপেনে তৃতীয় রাউন্ড কোর্টে না নেমে ওয়াকওভার দেওয়ার পরে সুস্থ হয়ে উঠে পেশাদার ট্যুরে মাত্র দু’টো ম্যাচ খেলে নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড স্ল্যামে নামেন। তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত কোনও সেট খোয়াননি। গেম হেরেছিলেন মাত্র কুড়িটা। উল্টে কখনও ছাদ ঢাকা আর্থার অ্যাশ সেন্টার কোর্টে প্র্যাকটিস আর ম্যাচ, দুটো ক্ষেত্রেই প্রথম শট মারার জন্য রাফার ‘ডাবল রুফ শট’ হিসেবে শিরোনামে তিনি। আবার কখনও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেডেরার-সুলভ নেটের দিকে পিছন ফেরা অবস্থায় দু’পায়ের ফাঁকে র্যাকেট এনে রিটার্ন মেরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন নাদাল। কিন্তু সেই মহাতারকা গত রাতে চার ঘণ্টার বেশি তুমুল লড়াইয়ের পরে পঞ্চম সেটের টাইব্রেকারে ৬-৬ অবস্থায় সহজ ফোরহ্যান্ড ভলি নেটে মেরে অপ্রত্যাশিত ছিটকে যান! ১-৬, ৬-২, ৪-৬, ৬-৩, ৬-৭ (৬-৮)।
পুইয়ের হাতে বিদায়ে নাদাল যে কী মারাত্মক হতাশ সেটা তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের মন্তব্যে স্পষ্ট। টেনিস বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, ম্যারাথন পাঁচ সেটের ম্যাচে মাত্র চার মরসুম আর ১১টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলা অনভিজ্ঞ পুই বারবার লড়াইয়ে ফিরেছেন ঠিকই। কিন্তু নাদাল চূড়ান্ত টাইব্রেকারের পুরো রাশ হাতে নিতে ওই সময় উইনার মারার জন্য বলটা নিজের কোর্টে একেবারে পছন্দের জায়গায় পেয়ে গিয়েছিলেন। যাকে বলে প্লেটে সাজানো অবস্থায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নেটে রিটার্ন মেরে বসেন! ‘‘ওটা একটা বিরাট ভুল আমার। এ বার ইউএস ওপেনকে নিজের জন্য খুব ভাল টুর্নামেন্ট করে তোলার দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটা নষ্ট করে ফেলার জন্য ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি,’’ বলেন তিনি।
ফরাসি বাবা আর ফিনিশ মায়ের সন্তান লুকা পুইয়ের ফ্রান্সে জন্মস্থান থেকে বেলজিয়াম সামান্য কয়েক কিলোমিটার। যে বছরের পর এ বারই প্রথম নাদাল যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে শেষ ষোলোয় ওঠেন, সেই ২০১৩-এ ‘প্রো’ হওয়া থেকে পুইয়ের বাসস্থান দুবাই। যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে এ বারই তিনি প্রথম ম্যাচ জেতেন। এ বছরই উইম্বলডনের পরে গতকাল ফ্লাশিং মেডোজে পুইয়ের জীবনের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা। সেই আনন্দে ছ’ফুট এক ইঞ্চি পুই এতটাই ভেসে যান যে, জিভ বার করে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, উল্টো করে পরা বেসবল টুপি মাথায়, বন্য দৃষ্টি নিয়ে মিনিটখানেক ধরে কোর্টে লাফালাফি করতে থাকেন। সঙ্গে এই ম্যাচে পুইয়ের ক্যাটক্যাটে গোলাপি-চড়া হলুদ টেনিস আউট-ফিট মিলেমিশে তাঁকে কোনও ক্লাবের শিক্ষার্থী প্লেয়ার দেখাচ্ছিল। গ্র্যান্ড স্ল্যামের জায়ান্ট কিলার নয়!
‘‘এই ম্যাচটা হয়তো আমার কেরিয়ার পাল্টে দেবে,’’ বলেন পেশাদার ট্যুরে এখনও একটাও খেতাব না পাওয়া পুই। নাদালের বিরুদ্ধে অতীতের একমাত্র সাক্ষাতে যিনি তিনটের বেশি গেম নিতে পারেননি (গত বছর মন্টে কার্লোতে)। সেই নাদালকে হারিয়ে পুই একটা নজিরও গড়ে ফেলেছেন যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে। তাঁর আগেই সঙ্গা আর মফিলস শেষ আটে ওঠায় ১৯৪৭-এর ৬৯ বছর পরে ফের তিন ফরাসি এ বার কোয়ার্টার ফাইনালে! নাদাল আবার ২০০৪-এর বারো বছর বাদে এ বারই গোটা মরসুম কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামে শেষ আটের মুখ দেখলেন না!
‘‘ম্যাচটায় আমার অ্যাটিটিউড ঠিক ছিল। প্রথম থেকে শেষ পয়েন্ট পর্যন্ত লড়েছি। কিন্তু আমার বোধহয় আরও বেশি কিছু করার দরকার ছিল। যা আজ আমার খেলায় ছিল না,’’ বলেন নাদাল। এর পরে তিনি যেটা যোগ করেছেন, দিনের শেষে মনে হচ্ছে সেটাই আসল, ‘‘সত্যি বলতে কিছু পয়েন্টে কোর্টের ভেতর ঠিক কী ঘটছে আমার কোনও ধারণা ছিল না। আমি ঠিক জানি না। স্রেফ সেই পয়েন্টগুলো হেরে গিয়েছি!’’