ময়দানে এখন জঙ্গলমহল

ফুলসাই হেমব্রম, সুনীল মান্ডি, রোহিনী মুড়া, শুকলাল মুর্মু, অজিত মাঝি—যে কোনও দিন সকালে ময়দানে কলকাতা লিগের বিভিন্ন ডিভিশনের ক্লাবের অনুশীলন দেখতে গেলেই পাওয়া যাবে এঁদের। মাওবাদী অঞ্চল থেকে আসা ওই ফুটবলাররা কেউ খেলছেন এরিয়ানে, কেউ কোল ইন্ডিয়ায়।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭ ০৩:৫১
Share:

উৎসাহী: কলকাতা লিগে খেলতে চান বলে বান্দোয়ান চ্যালেঞ্জার্স ক্লাবের মাঠে হাজির জঙ্গলমহলের বিভিন্ন গ্রামের ফুটবলাররা। তাঁরাই এখন ময়দানের ফুটবলের নতুন সাপ্লাই-লাইন। —নিজস্ব চিত্র।

বান্দোয়ান, ঝিলিমিলি, বাঁশপাহাড়ি বলরামপুর, শালবনি, বেলপাহাড়ি, দুয়ারসিনি—কয়েক বছর আগেও এ সব জায়গা ছিল মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। বোমা আর গুলির শব্দ ছিল যাঁদের নিত্যসঙ্গী, কী আশ্চর্য, মাওবাদীদের এক সময়ের সেই ডেরাই এখন হয়ে উঠেছে ময়দানি ফুটবলের অন্যতম সাপ্লাই লাইন।

Advertisement

ফুলসাই হেমব্রম, সুনীল মান্ডি, রোহিনী মুড়া, শুকলাল মুর্মু, অজিত মাঝি—যে কোনও দিন সকালে ময়দানে কলকাতা লিগের বিভিন্ন ডিভিশনের ক্লাবের অনুশীলন দেখতে গেলেই পাওয়া যাবে এঁদের। মাওবাদী অঞ্চল থেকে আসা ওই ফুটবলাররা কেউ খেলছেন এরিয়ানে, কেউ কোল ইন্ডিয়ায়। কারও আবার ঠিকানা নীচের ডিভিসনের ক্লাব ব্যাতোর স্পোর্টিং, চাঁদনি স্পোর্টিং বা ক্যালকাটা ইউনাইটেড। সংখ্যাটা কত? জেলবন্দি ছত্রধর মাহাতোর ছেলেকে দু’বছর আগে সই করিয়ে যিনি চমকে দিয়েছিলেন, সেই পোড় খাওয়া কোচ রঘু নন্দী বলছিলেন, ‘‘পঞ্চাশ-ষাট জন তো হবেই। উত্তর বা দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা হাওড়া-হুগলি থেকে ফুটবলার কম আসছে। ফলে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় যাচ্ছে অনেকেই। আমিও বিভিন্ন ক্লাবের জন্য ফুটবলার বেছেছি ওখান থেকে। সব ন্যাচারাল ট্যালেন্ট।’’ আর রঘুর স্ত্রী রত্না নন্দী তো পুরো একটা মেয়েদের টিমই গড়ে ফেলেছেন জঙ্গলমহলের মেয়েদের নিয়ে। সরোজিনী নাইডু ক্লাবের জার্সিতে যাঁরা খেলছেন মেয়েদের লিগে।

কয়েক সপ্তাহ আগে বান্দোয়ান ও লালগড় থেকে ২৭ জন ফুটবলারকে ট্রায়ালে দেখে বেছে এনেছেন ময়দানের প্রাক্তন ফুটবলার এবং ছোট দলের পরিচিত কর্তা অসিত রায়। রঘুর মতোই বেশ কয়েকটি ক্লাবের ফুটবলার জোগানের দায়িত্ব তাঁর হাতে। বলছিলেন, ‘‘দারুণ সব ছেলে আছে ওই সব এলাকায়। ফিটনেস খুব ভাল। শক্তি আছে। একটু ঘষে-মেজে নিলে ময়দান কাঁপিয়ে দেবে। খুব গরিব। সেভাবে খেতে পায় না। কলকাতায় আসতে ভয় পায়। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসছি। কিছু টাকা দেব।’’ তিনি জানালেন, বান্দোয়ান চ্যালেঞ্জার্স ক্লাবের মাঠে ট্রায়াল ডেকেছিলেন ওই ক্লাবের কর্তারা। প্রত্যন্ত গ্রামে মাইক বা লিফলেট দিয়ে প্রচার করেছিলেন। প্রথম দিনই হাজির দেড়শো ফুটবলার। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা জায়গায় গত কয়েক মাস ধরে ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন ক্লাবের কর্তা-কোচেরা। ফুটবলারের খোঁজে। এভাবেই ট্রায়াল নিয়ে বেছে আনছেন ফুটবলার। যাঁদের খেলতে দেখা যাবে কলকাতায়। এর আগে ফুলচাঁদ হেমব্রম, চুনারাম হাঁসদা, কৃষ্ণ টুডু, বিধান মান্ডিরা ময়দানে সফল হয়েছেন মাওবাদী অঞ্চল থেকে এসে। তবে সংখ্যাটা ছিল কম। কিন্তু গত দু’ তিন বছর ধরে প্রচুর ফুটবলার এসেছেন মাওবাদী অঞ্চল থেকে। কেন ছোট ক্লাবের কর্তারা ফুটবলারের খোঁজে প্রত্যন্ত গ্রামে? উঠে আসছে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট।

Advertisement

প্রিমিয়ার থেকে পঞ্চম ডিভিশন, প্রায় দু’শো ক্লাব অংশ নেয় আই এফ এ-র লিগে। নব্বই ভাগ ক্লাবেরই স্পনসর নেই। ব্যক্তিগতভাবে টাকা তুলে চলে কষ্টেসৃষ্টে। কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চল থেকে ফুটবলার সাপ্লাই লাইন আর আগের মতো নেই। যা পাওয়া যায় তাতে খরচ আনেক বেশি। কিন্তু পুরুলিয়া, বাঁকুড়া অঞ্চল থেকে ফুটবলার আনলে থাকার একটা জায়গা করে দিতে পারলেই অল্প খরচে টিম তৈরি হয়ে যায়। ঝামেলাও কম।

কলকাতায় খেলতে এসে অবশ্য পুরানো মাওবাদী জীবনের কথা বলতে নারাজ ফুলসাই-সুনীলরা। প্রশ্ন করলেই কুঁকড়ে যান। বলতে চান না, বাবা-মায়ের সঙ্গে অস্ত্র হাতে মিছিলে হাঁটার কথাও। তবে বান্দোয়ান ক্লাবের সচিব গোবিন আগরওয়াল বলছিলেন, ‘‘খোঁজ করলে দেখবেন সবাই তখন মাওবাদী ছিল। না হয়ে যে উপায় ছিল না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement