বৈঠক: নিঃশব্দে তৈরি হচ্ছেন এন শ্রীনিবাসন।ফাইল চিত্র
হায়দরাবাদে এক দিকে দশম আইপিএলের বোধন ঘটল হইহই করে। অন্য দিকে, নিঃশব্দে চলল ভারতীয় বোর্ড কর্তাদের গোপন বৈঠক। আর কে ছিলেন সেই বৈঠকের নেতৃত্বে? না, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেড় বছর আগে বোর্ডের মসনদ হারানো এন শ্রীনিবাসন!
আঁতকে ওঠার মতো শোনালেও সত্যিই— আইপিএলের উদ্বোধনের দিনে ভি ভি এস লক্ষ্মণের শহরেই ছিলেন শ্রীনি। যদিও মাঠে আসেননি তিনি। সরকারি ভাবে দেখা দেননি। প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতিও দিতে চাননি। খুব একটা জানাজানিও হতে দেননি। কিন্তু ছিলেন সকাল থেকেই।
আইপিএলের উদ্বোধনের জন্য সমস্ত রাজ্য সংস্থার প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই আমন্ত্রণকে কেন্দ্র করেও নাটক কম হয়নি। বোর্ডে এখন ক্ষমতায় রয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষকরা। তাঁরা গত মাসে আইপিএল নিলামে কর্তাদের ঢুকতেই দেননি। এমনকী, আইপিএল চেয়ারম্যান রাজী শুক্লেরও প্রবেশাধিকার ছিল না নিলামে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য কিন্তু আমন্ত্রণের চিঠি পাঠান শুক্ল এবং বোর্ডের পদাধিকারীরাই। সুপ্রিম কোর্টে লোঢা কমিটির রায় নিয়ে প্রবল চাপের মধ্যে থাকা বোর্ডে এমন সম্মেলন ঘটল অনেক দিন পরে। কোনও কোনও কর্তা ফোনে বলছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল বোর্ড ফিরে গিয়েছে পুরনো আমলে।’’
কিন্তু শুধুই নিজেদের মধ্যে ‘গেট টুগেদার’-এ আর সীমাবদ্ধ ছিল না আইপিএল সম্মেলন। হয়ে দাঁড়াল ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করার একান্ত বৈঠকও। আর সেই বৈঠকে নেতৃত্ব দিলেন শ্রীনিই। সুপ্রিম কোর্ট, লোঢা কমিটি এবং আদালত-নিযুক্ত পর্যবেক্ষক নিয়ে কোণঠাসা বোর্ডকে তিনিই আবার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কঠিন এই পরিস্থিতি থেকে বেরনোর রাস্তা কী, সে ব্যাপারে তিনিই এখন পথ দেখাচ্ছেন। নিয়মিত টেলিকনফারেন্স করছেন সব রাজ্য সংস্থার কর্তাদের নিয়ে। আগামী ৯ এপ্রিল বোর্ডের বিশেষ সাধারণ বৈঠকও ডাকা হয়েছে শ্রীনির কথাতেই।
আরও পড়ুন: মাথা কী ভাবে ঠান্ডা রাখতে হয় ধোনির থেকে শিখতে চান স্টোকস
শ্রীনির হায়দরাবাদ সফর নিয়ে সরকারি ভাবে কেউ মুখ খুলছেন না। বলা হচ্ছে, ব্যক্তিগত কাজে তাঁর এ দিন হায়দরাবাদেই থাকার কথা ছিল। কর্তারা যে হোটেলে উঠেছিলেন, সেখানে তিনি না উঠে ছিলেন অন্য হোটেলে। সেখানেই ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানান অনুগামী রাজ্য সংস্থার কর্তাদের। হায়দরাবাদে উপস্থিত অনেকেই শ্রীনির নেমন্তন্ন পেয়ে সেখানে যান। আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল-ও গিয়েছিলেন বলে খবর। যদিও আদালতের নির্দেশে অপসৃত অনুরাগ ঠাকুর বা অজয় শিরকে হায়দরাবাদে ছিলেন না। তাই শ্রীনির আমন্ত্রণ রক্ষা করার ব্যাপারও তাঁদের ছিল না।
এমনিতে আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কয়েকটি ছবি দেখে মনে হয়েছে, কর্তারা আর আগের মতো কোণঠাসা নেই। বোধনের মঞ্চে যেমন ভারতীয় ক্রিকেটের চার মহারথিকে সংবর্ধনা জানানো হল। সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায, ভি ভি এস লক্ষ্মণ এবং বীরেন্দ্র সহবাগ। পর্যবেক্ষকদের প্রধান বিনোদ রাই স্মারক তুলে দিলেন সবার প্রথমে সহবাগের হাতে। আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল সংবর্ধনা দিলেন সবার শেষে তেন্ডুলকরকে।
এই দৃশ্যগুলো সকলের চোখের সামনেই ঘটল। অলক্ষ্যে যেটা হল, তার প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। গোপন বৈঠকে একপ্রস্ত কথা হয়ে থাকল ৯ এপ্রিল বিশেষ সাধারণ সভার বিষয় নিয়ে। ওই বৈঠকে বোর্ড সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে আইসিসি-র সভায় কে যাবেন, তা নিয়ে। অন্তত অর্ধেক সংখ্যক সদস্য চান, শ্রীনি প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ফের আইসিসি-তে যান। তিনি গেলেই শশাঙ্ক মনোহর-রা ভারতের ২০ শতাংশ লভ্যাংশের দাবি নাকচ করতে পারবেন না। বোর্ডের থেকে প্রাপ্য রাজ্য সংস্থাগুলোর অনুদানও তা হলে কমে যাবে না।
সমস্যা হচ্ছে, বোর্ড রাজনীতিতে শ্রীনির অভাবনীয় প্রত্যাবর্তন ঘটলেও এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে, তিনি আগের মতো নিরঙ্কুশ সমর্থন পাচ্ছেনই। রাজীব শুক্ল আইপিএল চেয়ারম্যান হিসেবে ফের সক্রিয়। তিনি যতই শ্রীনির সঙ্গে ব্রেকফাস্ট টেবলে গিয়ে দেখা করে আসুন, পুরোপুরি কি তাঁর পাশে আছেন? কেউ জানে না। শোনা গেল সবচেয়ে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট দিল্লির সি কে খন্না নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, আগামী ছ’মাস তিনি যদি বোর্ডের কার্যকরী প্রেসিডেন্ট থাকেন, তা হলে আইসিসি-তে তিনি কেন যাবেন না?
আবার কোনও কোনও কর্তা ভাবছেন, অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য চাইবেন। জেটলির কথায় এক সময় বোর্ড চলত। এখনও তাঁর অনুগামীর সংখ্যা মোটেও কম নয়। কিন্তু লোঢা কমিটি এবং সুপ্রিম কোর্টের ব্যাপারস্যাপার এসে যাওয়ার পরে দেশের অর্থমন্ত্রী নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। লোঢা সুপারিশ অনুযায়ী, মন্ত্রী হওয়ায় তিনি বোর্ডের মধ্যে আর থাকতেও পারবেন না। তবু কারও কারও মনে হচ্ছে, একমাত্র জেটলির পরামর্শই এই জটিল পরিস্থিতি থেকে বোর্ডকে উদ্ধার করতে পারেন।
ফুল থাকলে তাই কাঁটাও থাকছে শ্রীনির প্রত্যাবর্তনের পথে। যে কারণে ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে তিনি সামান্য বিরোধিতার মুখোমুখি হলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, বিজেপি হাইকম্যান্ডের সমর্থন শ্রীনি জোগাড় করতে পারবেন কি না। বুধবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনও সঙ্কেত নেই শ্রীনি শিবিরের কাছে।
মতপার্থক্য হয়ে যদি ৯ এপ্রিল আইসিসি প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি বোর্ডের সভায় ভোটাভুটিতে চলে যায়, শ্রীনি কি জিতবেনই? তাঁর শিবিরে এখন সেই অঙ্ক কষাই চলছে। এক জন বললেন, ‘‘যদি সরকার নিরপেক্ষও থাকে বা বলে দেয়, মাথা গলাতে চায় না তা হলেও অ্যাডভ্যান্টেজ শ্রীনিবাসন।’’ আবার এটাও দেখার যে, শ্রীনিকে যদি ভারতীয় বোর্ডের সদস্যরা প্রতিনিধি হিসেবে বাছেন, তা হলে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান কী দাঁড়ায়? দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি তাদের রায়ে অপসৃত কারও নির্বাচন মেনে নেবে?
আইপিএলের উদ্বোধনী মঞ্চেই হয়তো শুরু হয়ে গেল ভারতীয় বোর্ড রাজনীতির আর এক রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়। আগামী কয়েক দিন যেখানে টি-টোয়েন্টির মতোই উত্তেজক কিছু ‘শট’ দেখা যেতে পারে!