শপথ: ব্যর্থতা ভুলে ওয়াংখে়ড়ে থেকেই একজোট হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মহড়া শুরু করে দিল কলকাতা নাইট রাইডার্স টুইটার
একটা দল প্রথম ম্যাচে মই পেয়ে গিয়েও এখন সাপের মুখে। অন্যটা প্রথমে সাপের মুখে পড়েও সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এখন মই পেয়ে গিয়েছে! আইপিএলে এমন সাপ-লুডো খেলা চলতেই থাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলতে গেলে, বেগুনি জার্সিধারীরা পড়ছে। হলুদ পাখিরা আবার উড়ছে।
পর-পর দু’টো ম্যাচ হেরে গাড্ডায় থাকা কলকাতা নাইট রাইডার্স। পর-পর দু’টো ম্যাচ জিতে মাথার উপরে ফের রোদ্দুর খুঁজে পাওয়া চেন্নাই সুপার কিংস। আজ, বুধবার, ওয়াংখেড়ের মাঠে মুখোমুখি। দুই বিশ্বজয়ী সেনাপতি যাবেন টস করতে কিন্তু ক্রিকেটে অতীত ঐশ্বর্য যদি বিশ্বাসের তরঙ্গ তৈরি করে, তা হলে সেটাও থাকবে হলুদ টুপি পরা অধিনায়কের দিকে। ২ এপ্রিল, ২০১১, এ মাঠেই যাঁর ছক্কায় বিশ্বকাপ জয়ের ‘মহেন্দ্রক্ষণ’ তৈরি হয়েছিল।
দুই যুযুধান অধিনায়ক নিশ্চয়ই নতুন করে টের পেয়ে গিয়েছেন, কত দ্রুত পৃথিবী ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। দিন দশেক আগে অইন মর্গ্যান যখন জয় দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন, বলাবলি হচ্ছিল, মরুদেশে গত বারের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে নাইটদের দিশা দেখানোর নতুন অধিনায়ক এসে গিয়েছেন। মর্গ্যান দ্রুতই আবিষ্কার করেছেন, ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করা আর আইপিএলের মতো হাইভোল্টেজ টুর্নামেন্টে ভারতের কোনও শহরকে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে কী তফাত! লন্ডন বা নটিংহ্যামে ম্যাচ হারলে কেউ তাঁর কুশপুতুল পোড়াবে না, এখানে অহরহ হবে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দলের বাইরে রাখার সময় গ্রেগ চ্যাপেল এক বার বলেছিলেন, ‘‘ভারত হারলে কলকাতায় আমার যা কুশপুতুল পোড়ে, প্রত্যেকটার জন্য এক ডলার করে পেলেও আমি কোটিপতি হয়ে যেতাম।’’ ও দেশে তারকা হয়েও টিউব স্টেশনে দিব্যি ঢুকে পড়া যায়, কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড্স কিনতে লাইনে দাঁড়ানো যায়। ভক্তদের ভিড়ে চাপা পড়ার ভয় নেই। রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়া সমর্থকদের বিশাল প্রত্যাশা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ কাঁটাছেড়া হওয়া, প্রত্যেক আমজনতার নিজস্ব বিশেষজ্ঞ মতামত— কোনওটাই কালবৈশাখীর মতো আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। তিনি তাই যতই ওয়ান ডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হন, যতই সাদা বলের ক্রিকেটে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া মহানায়ক হন, আইপিএল অন্য রকম চাপের খেলা। দু’টো ম্যাচ হেরেছেন, নিজে ব্যাটে রান পাচ্ছেন না, আজ ওয়াখংড়েতে হারলেই হল! কোরাস পাল্টে যেতে সময় লাগবে না। ‘করব, লড়ব, জিতব রে’ তখন হয়ে যাবে, ‘এ কাকে অধিনায়ক করে আনলি রে’!
মর্গ্যানকে সফল হতে হলে সবার প্রথমে এই চাপকে সপাটে ওভারবাউন্ডারি মারতে হবে। প্রথম ম্যাচে কোহালিদের কাছে হারের পরে যেমন ধোনিকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছিল, রাজা মিডাসের সেই ছোঁয়া কি আর কখনও ফিরে আসবে? ধোনি নিজে রানে ফেরেননি এখনও, ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছে অতীতের ছায়া মাত্র, কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে এখনও গীতার সেই স্থিতধী পুরুষ! মগজাস্ত্রেই ম্যাচ বার করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন! রাতের ম্যাচে শিশিরে ভেজা বল পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে শুকনো বল তুলে দিলেন স্পিনারের হাতে। এক চালে বাজিমাত। এমন সজাগ অধিনায়ক দলের সম্পদ। এক রাতে তাঁকে দীপক চাহারের সুইং জেতাল। অন্য রাতে জেতাল রবীন্দ্র জাডেজা-মইন আলির স্পিন। চেন্নাই বোলিংয়ে বড় কোনও তারকা নেই। কিন্তু হাল্কা ভাবে নিলে ঠকতে হবে। ধোনি যখন খড়গপুরের স্টেশনে দাঁড়িয়ে টিটি-র চাকরি করছিলেন, কে ভেবেছিল, এই লোকটার নেতৃত্বেই এক দিন ভারত বিশ্বকাপ জিতবে! আগাগোড়া তাঁর ক্রিকেটজীবন জুড়ে থেকেছে এই দর্শন। চুপচাপ, নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যাও। চাহার, মইনদের মধ্যেও সেই ছায়া। নীরব ঘাতক। সঙ্গে সুরেশ রায়না, ফ্যাফ ডুপ্লেসিদের অভিজ্ঞতা আর স্যাম কারেনের তারুণ্য। রবীন্দ্র জাডেজার অসামান্য অলরাউন্ড দক্ষতা। ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যেও এ
গিয়ে সিএসকে।
তার মধ্যে আবার কেকেআর ব্যাটিং ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে পড়ে আছে। ডাক্তার-বদ্যিরা যাঁরা বসে আছেন ডাগআউটে, তাঁদের দেখে ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। হাতুড়ে বলেই মনে হচ্ছে। শুভমন গিল ফেরারি গাড়ির মতো ছোটা শুরু করে মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ছেন। তাঁকে কেউ বলছে না কেন যে, ‘‘ভাই, শিখর ধওয়নকে দেখো। এই বয়সেও কেমন দিল্লিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখনও যদি শিখরেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে আর তুমি ঘুরে বেড়াও, তা হলে কবে আর খেলবে!’’ নীতীশ রানা, রাহুল ত্রিপাঠী এত ভাল শুরু করলেন প্রথম ম্যাচে। কিন্তু ধারাবাহিকতা কোথায়! লিপ ইয়ারে একটা ভাল ইনিংস খেললে লোকে কেন মনে রাখবে? ভারতীয় দল নির্বাচনের সময়েও বা কেন আলোচনায় নাম উঠবে!
নেতার ব্যাটে আশ্বাস নেই। অধিনায়কত্ব জুড়ে সংশয়, ধাঁধা আর অনিশ্চয়তা। বিস্ময় স্পিনার সিভি বরুণকে দুই উইকেট নেওয়ার পরেও তুলে নিচ্ছেন, চল্লিশের হরভজনকে উনিশতম ওভারে বল করাচ্ছেন, ম্যাক্সওয়েল ঝড় থামাতে শাকিবের বাঁ হাতি স্পিনকে অস্ত্র করছেন! অতি আগ্রাসী ব্যাটিং নীতি বিপদ ডেকে আনছে দেখেও ‘প্ল্যান বি’ ভাবছেন না! এক-এক সময় মনে হচ্ছে, দুই অধিনায়কের মস্তিষ্কই না আসল তফাত গড়ে দিয়ে যায়
বুধবারের ওয়াংখেড়েতে!
নাইট শিবিরে আরও সব উপসর্গ রয়েছে। শাকিব-আল-হাসান মন্থর ব্যাট করছেন। স্ট্রোক বেরচ্ছে না তাঁর হাত দিয়ে, তাই বল নষ্ট হচ্ছে। দীনেশ কার্তিককে দেখে মনে হচ্ছে, ব্যাট করার ইচ্ছাই নেই। যেন জোর করে কেউ তাঁকে ক্রিজে ঠেলে পাঠাচ্ছে। আন্দ্রে রাসেলের গত মরসুম থেকেই ব্যাটে অন্ধকার। দেখে মনে হচ্ছে, পুরোপুরি ফিটও নন। দু’ওভার বল করে আর দু’টো ছক্কা মেরেই যদি ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি দলকে জেতাবেন
কী করে?
ক্রিকেট মহলে জোর আলোচনা, সুনীল নারাইনকে কেন বাইরে রাখা হচ্ছে? নারাইন ব্যাট হাতেও ঝোড়ো রান করে দিতে পারেন। স্পিনার হিসেবে তিনি কতটা আর খারাপ করবেন? তবু নারাইন নামটার একটা ওজন আছে। প্রতিপক্ষ এতটা চাপমুক্তও থাকতে পারবে না। চেন্নাইয়ের স্পিন-সহায়ক, মন্থর পিচ ছেড়ে মুম্বইয়ে এসেছে কেকেআর। তাই রাসেলের ব্যাটে ঝাঁঝ ফেরার আশা থাকবে। যদিও ওয়াংখেড়েতে আইপিএল ম্যাচে কোনও ছক্কা নেই রাসেলের। গড় দশের নীচে। আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য। ওয়াংখেড়ের বাইশ গজ পেসারদের সাহায্য করে বেশি। হরভজনের জায়গায় নিউজ়িল্যান্ডের ফাস্ট বোলার লকি ফার্গুসনকে নামানোর কথাও ভাবা যেতে পারে।
যে শহরে তাঁকে লোকে বাজিগর বলে, সেখানে সম্মানের ম্যাচ। নাইটদের মালিক নিশ্চয়ই মনে-মনে দলের উদ্দেশে বলবেন, ‘‘আমার একটা ফিল্ম আছে। চেন্নাই এক্সপ্রেস। আজ অন্তত মানটা রেখো, তোমরা!’’