নায়ক: সেঞ্চুরির পরে রাহুল। তাঁর বিধ্বংসী ইনিংসেই এল জয়। পিটিআই
দু’টো মোড় ঘোরানো ওভার। বিরাট কোহালির মতো চ্যাম্পিয়ন ফিল্ডারের হাত থেকে পড়ে যাওয়া দু’টো ক্যাচ। ট্যাটুতে বোঝাই এতকালের নিন্দিত এক ব্যাটসম্যানের বন্দিত হয়ে ওঠা।
দুবাইয়ে বৃহস্পতিবার রাতে এ সবই রক্তাক্ত করে দিয়ে গেল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরকে। যারা চিরকালই আইপিএলের সব চেয়ে তারকা ঝলমলে দল, কিন্তু কোনও দিনই সেই চাঁদের হাটের সুনাম রাখতে পারেনি। আজ পর্যন্ত আইপিএল জেতেনি। এ বারে প্রথম ম্যাচে জিতলেও বৃহস্পতিবার যে ভাবে ৯৭ রানে দুরমুশ হল কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের হাতে, তাতে প্রশ্ন উঠে যেতে পারে, এখান থেকেই না ফের শনির দশা লাগতে শুরু করে!
খেলাটার নাম যে ক্রিকেট! কখন কাকে তুলবে, কাকে ধরাশায়ী করবে কে জানে! এ দিন যেমন কোহালি ফেললেন দু’টি ক্যাচ। আর ডেল স্টেন উনিশতম ওভারে দিলেন ২৬ রান। ডিন জোন্সের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে এমনিই ক্রিকেটমহল স্তব্ধ ছিল এ দিন। তার উপরে কোহালির ক্যাচ ফেলা আর স্টেনের লজ্জার ওভারে আরওই যেন নীরবতা যোগ হল। তাতে অবশ্য কে এল রাহুলের কৃতিত্বকে খাটো করা যাবে না। ট্যাটুর বাহারের জন্য তাঁকে স্বচ্ছন্দে ভারতীয় ক্রিকেটের ডেভিড বেকহ্যাম বলে ডাকা যায়। তবে বেকহ্যামের মতো সুখ্যাতি নয়, এত কাল রাহুলের জন্য ধিক্কারই বেশি অপেক্ষা করে থেকেছে। বলাবলি হয়েছে, তাঁর শরীরে যত ট্যাটু, অত রানও তো করেন না! ভিজির মহারাজাকে নিয়ে যেমন বলা হত, যতগুলো রোলস রয়েস আছে, তত রানও করেন না।
আরও পড়ুন: ইয়ো-ইয়ো পরীক্ষা কী, প্রধানমন্ত্রীকে বোঝালেন বিরাট
কর্ণ জোহরের সেই কুখ্যাত কফি শো-তে হার্দিক পাণ্ড্যের সঙ্গে ছিলেন রাহুল। ম্যাঙ্গালুরুতে জন্ম তাঁর। সেখানকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজ়ির প্রফেসর ছিলেন বাবা-মা। কফি শোয়ের বিতর্ক সুনামির মতো আছড়ে পড়েছিল শিক্ষিত পরিবারে। অনেক দিন অঘোষিত লকডাউন চলেছিল রাহুলের। গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। উনিশ মাস পরে ফের বন্দনার পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন ঘটল তাঁর। স্টেনের উনিশতম ওভার থেকে নিলেন ২৬ রান। আর শিবম দুবের শেষ ওভার থেকে ২৩। কোহালি যখন পরপর দু’টো ক্যাচ ফেললেন, রাহুল ছিলেন নব্বইয়ের আশেপাশে। শেষ করলেন ৬৯ বলে ১৩২ নট আউটের মরুঝড়ে। আইপিএলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানের করা সর্বোচ্চ স্কোর। এত দিন সেই রেকর্ড ছিল ঋষভ পন্থের (১২৮ নট আউট) দখলে। ১৪টা বাউন্ডারি, ৭টা ওভার বাউন্ডারির তাণ্ডব সেরে যখন ফিরছেন, ‘ইউনিভার্স বস্’ ক্রিস গেলও হাততালি দিচ্ছেন। গ্যালারিতে উপস্থিত প্রীতি জিন্টা মুগ্ধ। গেলকে বেঞ্চে বসিয়ে খেলতে নামাটা তলোয়ারহীন যুদ্ধে যাওয়ার মতো দেখাতে পারে। কিন্তু অধিনায়ক রাহুলকে ম্যাচ ও বাজি জেতালেন ব্যাটসম্যান রাহুল।
শেষ দুই ওভারে রাহুলরা তুললেন ৪৯ রান। ওখানেই ম্যাচটা চলে গেল বিরাটদের হাতের বাইরে। তার আগে মনে হচ্ছিল, কিংস ইলেভেন টেনেটুনে ১৭০-১৮০ তুলবে। তারা শেষ করল ২০৬-৩ নিয়ে। ডাকাবুকো কোহালিও কেমন যেন তুবড়ে গেলেন অকল্পনীয় দু’টো ক্যাচ ফসকে। ব্যাট হাতে করলেন ৫ বলে ১। আর তাঁকে আউট করে ফের সেই স্যালুট-সেলিব্রেশন করে গেলেন শেল্ডন কোট্রেল। তিন ওভারের মধ্যেই চার রানে তিন উইকেট চলে গেল আরসিবির। আর শিরদাঁড়া সোজা করতে পারেনি তারা।
আমিরশাহিতে শিশিরের ভয়ে সব অধিনায়ক টসে জিতে ফিল্ডিং নিচ্ছেন। যাতে পরে তাঁদের স্পিনারদের বল করতে না হয়। বুধবার মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আর এ দিন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের প্রথমে ব্যাট করেও একপেশে জয় এই ফর্মুলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। রোহিত এবং রাহুলেরা দেখিয়ে দিলেন, প্রথমার্ধেই ঝড় তুলে দিতে পারলে আর শিশির পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য পড়েই থাকে না। তা ছাড়া পরে বোলিং করে এ দিন লেগস্পিনার রবি বিষ্ণোই নিয়ে গেলেন তিন উইকেট। মুরুগান অশ্বিন তুললেন তিন উইকেট। আগের দিন চহাল ভেঙেছিলেন সানরাইজ়ার্স হায়দরাবাদকে। তা হলে স্পিনাররা পরে বোলিং করে সফল হবে না, এই তত্ত্বই বা কী করে চলবে?
রাহুলের ট্যাটুর পৃথিবীতে ঢুকলে অবশ্য অন্য এক মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা ট্যাটুর নেপথ্যে অর্থ আছে। পায়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে করানো কম্পাস, মিলান থেকে ঘোড়ার জুতো, মায়ামিতে করা খঞ্জর। রূপান্তর বোঝাতে রয়েছে প্রজাপতি, কব্জিতে দু’দিকে মুখ করা দু’টি তির। এর অর্থ? জীবন কখনওসখনও পিছনে টানার চেষ্টা করবে কিন্তু তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। কর্ণ এপিসোডের পরে আরও যোগ হয়েছে। নতুন শুরু বোঝানোর জন্য ফুল। বেকহ্যাম-ভক্ত রাহুল এক বার বলেছিলেন, ‘‘অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়াই ধর্ম। জীবনের ভুলের দিকে এ ভাবেই ফিরে তাকাতে চাই আমি, তিক্ততা নিয়ে নয়।’’ সম্ভবত সেই কারণেই কি সেঞ্চুরি করে কান ধরলেন? না কি দু’কান ঢেকে বোঝাতে চাইলেন, বহির্বিশ্বের নিন্দা, ঘৃণা, ধিক্কার আর শুনতে চাই না?
কে এল রাহুল পার্ট টু-তে স্বাগত!