জুটি: চ্যাম্পিয়ন করার নেপথ্যে দুই কারিগর। পাপা ও কোচ কিবু। নিজস্ব চিত্র
মুখে সবুজ আবির। কাঁধে মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন পতাকা। গ্যালারির সামনে গিয়ে সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন জোসেবা বেইতিয়া, ফ্রান গঞ্জালেসরা। কখনও আবার সতীর্থদের সঙ্গে মাঠের মধ্যেই ডোয়েন ব্র্যাভোর ‘চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন’ গানের সঙ্গে নাচছেন। কিন্তু পাপা বাবাকর জিয়োহারা গেলেন কোথায়? মোহনবাগানের আই লিগ জয়ের অন্যতম নায়ক তখন ভিডিয়ো কলে এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু সমর্থকদের নিজস্বীর আব্দারে দ্রত শেষ করতে হল কথোপকথন। ব্যস্ততার মধ্যেই আনন্দবাজারের মুখোমুখি হলেন মোহনবাগান তারকা।
প্রশ্ন: আই লিগের মাঝপথে মোহনবাগানে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে এত দ্রুত দলের সঙ্গে মানিয়ে নিলেন?
পাপা: সতীর্থেরা যদি পাশে থাকে, তা হলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। ফুটবলার থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যেরা— প্রথম দিন থেকে সকলে আমাকে সাহায্য করেছে। ওদের জন্যই আমি দ্রুত মানিয়ে নিতে পেরেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের দলটা এ বার অসাধারণ। প্রত্যেকে অনবদ্য খেলছে। সেটাও আমাকে সাহায্য করেছে দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
প্র: সবুজ-মেরুন জার্সিতে প্রথম তিনটি ম্যাচে গোল পাননি। সমর্থকদের অনেকেরই তখন মনে হয়েছিল, আপনাকে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। অথচ এখন আপনিই মোহনবাগান সমর্থকদের নয়নের মণি। ১২ ম্যাচে ১০টি গোল ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। কেমন অনুভূতি হচ্ছে?
পাপা: (হাসি) বিশ্বাস করুন, আমি কখনওই হতাশ হয়ে পড়িনি। আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলাম। জানতাম, গোল আমি করবই। কোচ ও সতীর্থেরাও আমাকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছে। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ডার্বিটা ছিল আমার চতুর্থ ম্যাচ। সে দিনই প্রথম গোল করেছিলাম। সমর্থকদের প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই। মোহনবাগানে প্রথম বার খেলতে এসেছি। আমার সম্পর্কে ওঁদের কোনও ধারণা ছিল না। আশা করছি, এখন সমর্থকদের প্রত্যশাপূরণ করতে পেরেছি। ওঁরাই আমার অনুপ্রেরণা
প্র: দশটি গোলের মধ্যে কোন গোলটিকে সেরা বাছবেন?
পাপা: অবশ্যই আইজল এফসির বিরুদ্ধে গোলটা। আমার গোলে শুধু মোহনবাগান জেতেনি, আই লিগে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে।
প্র: আই লিগ অবনমন বাঁচানোর লড়াই করছে আইজল। সেই দলের বিরুদ্ধে গোলের জন্য ৮০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল কেন?
পাপা: ফুটবল খেলাটা সহজ নয়। কোনও দলই দুর্বল নয়। আইজল দারুণ লড়াই করেছে। শুরু থেকে আমাদের কঠিন লড়াইয়ের সামনে ফেলে দিয়েছে। এই কারণেই গোল পেতে দেরি হয়েছে। তবে কখন গোল পেলাম, তা আমার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে জয়টাই আসল। সেই লক্ষ্য আমরা পূরণ করতে পেরেছি।
প্র: প্রথমবার ভারতে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?
পাপা: অসাধারণ। এখানে আসার আগে ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে খুব একটা ধারণা আমার ছিল না। ফুটবলের প্রতি এই আবেগ দেখে আমি অভিভূত। ক্লাবের পতাকা নিয়ে, সবুজ-মেরুন জার্সি পরে যে ভাবে সমর্থকেরা প্রত্যেক ম্যাচে আমাদের উৎসাহ দিয়েছে, তার কোনও তুলনা হয় না। ওঁদের ভালবাসার মূল্য দিতে পেরেছি বলে দারুণ আনন্দ হচ্ছে। (কথা থামিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে দৌড়ে গেলেন গ্যালারির সামনে)
প্র: আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার যাত্রাটা বলবেন?
পাপা: সেনেগালের সকলে ফুটবল খেলে। একমাত্র আমাদের বাড়িতেই ফুটবল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র আমি ফুটবল খেলতাম। ফুটবলের প্রতি আগ্রহ না থাকলেও আমার বাবা-মা কখনও আপত্তি করেননি। আমার উৎসাহ দেখে ভর্তি করে দিয়েছিলেন একটি অ্যাকাডেমিতে। আমার জীবন বদলে যায় ২০০৬ সালে পর্তুগালের মারিমিতো ‘বি’ দলে সুযোগ পাওয়ার পরে। ২০১২-’১৩ মরসুমে যোগ দিই লা লিগার ক্লাব সেভিয়াতে। সেখান থেকে লোনে খেতাফে ও লেভান্তের হয়ে খেলেছি। লা লিগায় টানা চার মরসুম খেলার পরে ফিরে গিয়েছিলাম মারিমিতোয়। তার পরে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ইউনাইটেডে যোগ দিই। সেখান থেকে মোহনবাগানে এসেছি।
প্র: লা লিগায় লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো তারকাদের বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?
পাপা: দারুণ। আমার প্রিয় ফুটবলার মেসি। কিন্তু মাঠে নামার পরে তা কখনও মনে রাখিনি।
প্র: ছেলের সঙ্গে কী কথা হল?
পাপা: ও দারুণ খুশি। স্কুল থাকায় খেলাটা দেখতে পায়নি। তাই স্কুল ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিডিয়ো কল করেছিল। কল্যাণীতে আসার আগে ওকে কথা দিয়েছিলাম, চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরব।
প্র: ছেলেকেই কি জয় উৎসর্গ করছেন?
পাপা: (হাসি) না না, দু’দিন আগেই নারী দিবস ছিল। তাই আমার তিন মেয়ে আয়েষা, ইয়েভা ও মিরাকে এই জয় উৎসর্গ করছি।
প্র: মিশন আই লিগ সম্পূর্ণ। এ বার সামনে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ডার্বি। কবে থেকে প্রস্তুতি শুরু করবেন?
পাপা: আজকের রাতটা আমাদের উপভোগ করতে দিন। অনেক লড়াই ও পরিশ্রম করে এই সাফল্য পেয়েছি। ডার্বি নিয়ে পরে ভাবব।