বিকাশ নার্জিনারি। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: সদ্য তো ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান হল। এক সময়ের ইস্টবেঙ্গল ফুটবলার হিসাবে সেই দিনটা আপনি কীভাবে পালন করলেন?
উত্তর: ওই দিনটাতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অনুষ্ঠানে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অফিসের একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখেছি। খুব ভাল লেগেছে।
প্রশ্ন: আলিপুরদুয়ারেও তো ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ পূর্তি উদ্যাপন করা হয়েছে।
উত্তর: হ্যাঁ। তবে আমি প্রথমে শুনে বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আগে জানতাম উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ ও আশেপাশে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান দলের অনেক সমর্থক রয়েছেন। কিন্তু এখন দেখছি আমাদের আলিপুরদুয়ার জেলাতেও ইস্টবেঙ্গলের অনেক সমর্থক। যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের খেলাও দেখেন।
প্রশ্ন: আলিপুরদুয়ারে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের আশা ছিল, তাদের প্রিয় ক্লাবের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে আপনি উপস্থিত থাকবেন...
উত্তর: হ্যাঁ। ওনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার জন্যই আলিপুরদুয়ারেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। সে জন্য খুব খারাপ লেগেছে।
প্রশ্ন: বীরপাড়ার অখ্যাত রাঙালিবাজনার এমএলএ হাটখোলা গ্রাম থেকে উঠে এসে আপনি কলকাতার ফুটবল ময়দানে সাফল্যের সঙ্গে খেলেছেন। দীর্ঘ এই পথটা কীভাবে পার করলেন?
উত্তর: সত্যি কথা বলতে, ছোট থেকে খুব গরিব পরিবারেই বড় হয়েছি। ফুটবলার হওয়ার কথাও কখনও মাথায় আসেনি। তাছাড়া নিজের ১৭বছর বয়স পর্যন্ত আমি তো কখনও ফুটবল খেলিওনি। বরং সেই সময় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলে বেড়াতাম। তবে সেটাও পাড়ার আর পাঁচজনের মতো।
প্রশ্ন: তাহলে ফুটবলে এলেন কী করে?
উত্তর: সেটাও একটা মজার ঘটনা। এক বার কাগজে সাইয়ের ফুটবল ট্রায়ালের একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। সেটা দেখে আমার পাড়ার সম্পর্কে এক মামা (পাড়াতুতো মামা) সুভাষ কার্যি শিলিগুড়িতে সেই ট্রায়ালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমাকেও সঙ্গে যাওয়ার কথা বলেন। কোনও কিছু না ভেবে আমি ওনার সঙ্গে শিলিগুড়ির ওই ট্রায়ালে চলে যাই। সত্যিই অবাক কাণ্ড। সেখানে আমি সুযোগও পেয়ে যাই। সাইয়ের প্রশিক্ষণে আমায় দার্জিলিং-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে চার বছর থাকি। কিন্তু সেই চার বছরে কেন জানি না মনে হয়েছিল, সাইয়ের দার্জিলিং ক্যাম্পের দিকে কারও তেমন কোনও ফোকাস নেই। এরপর সাই ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসি। জলপাইগুড়িতে রায়কতপাড়া স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনে খেলা শুরু করি।
প্রশ্ন: তারপর?
উত্তর: এক বছর সময় ধরে আরএসএ-তেই খেলেছিলাম। তবে সেখানে খেলতে খেলতেই ইস্টার্ন রেলের ফুটবল কর্তাদের নজরে পড়ে যাই। ফলে কলকাতায় ওই দলে সুযোগ পেয়ে যাই। তাদের হয়ে কলকাতা লিগ খেলি। ওই দলে খেলার সময় কোচ সঞ্জয় সেনের সংস্পর্শে আসি। সঞ্জয় স্যারই আমার জীবনের সেরা কোচ। ইস্টার্ন রেলের হয়ে দু’বছর খেলার পর ইস্টবেঙ্গল সিনিয়র দলে সুযোগ পাই।
প্রশ্ন: সেখানকার অভিজ্ঞতা?
উত্তর: আমি স্ট্রাইকার পজিশনে খেলি। কলকাতার প্রধান ক্লাবগুলিতে যে পজিশন বা জায়গায় নামিদামি খেলোয়াররা খেলেন। ফলে ইস্টবেঙ্গলে স্বাক্ষরের সুযোগ পেলেও খেলার সুযোগ নিয়ে মনের ভিতরটা একটু খারাপই ছিল। তবে লাল-হলুদ জার্সিতে সুযোগ পাওয়া প্রথম ম্যাচটা কোনওদিন ভুলব না। মহামেডান এসির বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে প্রথম সেই ম্যাচে আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম। তারপরও অবশ্য আমার কঠিন সময় কেটেছে। যার জেরে ইস্টবেঙ্গল ছেড়েও দেই।
প্রশ্ন: ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে তো আপনি অসমে চলে গিয়েছিলেন?
উত্তর: হ্যাঁ। সেখানকার একটা ক্লাবে খেলা শুরু করি। তবে তার মধ্যেই সন্তোষ ট্রফির জন্য বাংলা দলে ডাক পাই। ফের ছুটে আসি কলকাতায়। সন্তোষ ট্রফি খেলি। আমরা সে বার চ্যাম্পিয়নও হই। বাংলার হয়ে আমি গোলও করি।
প্রশ্ন: এরপর কী করলেন?
উত্তর: আপনাকে শুরুতেই বলেছিলাম, আমি খুব গরিব ঘর থেকে উঠে আসা একজন। এই অবস্থায় সন্তোষ ট্রফি খেলার পর খেলোয়াড় কোটায় আয়কর দফতরে একটা চাকরির সুযোগ এসে পড়ে। আমি তাতে যোগও দিই। হয়তো আমার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ততটা ভাল থাকলে সেই সময় শুধুমাত্র খেলার দিকেই নজর দিতাম। কিন্তু সেই সুযোগ ছিল না।
প্রশ্ন: এর ফলে কি ফুটবল থেকে দূরে সরে গেলেন?
উত্তর: একে বারেই না। বরং, তারপরও কলকাতায় ফুটবল খেলে গিয়েছি। এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে অনুশীলন করি। কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: সেটা কি?
উত্তর: এক বার একসঙ্গে দু’টো ক্লাব থেকে আমার কাছে সুযোগ এসেছিল। একটা মহামেডান স্পোর্টিং, অন্যটা ভবানীপুর। আমি মহামেডান স্পোর্টিং-এ স্বাক্ষর করি। আর তারপরই যেন আমার উপর থেকে অনেকের ফোকাস চলে যায়।
প্রশ্ন: ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলার সময়ের তেমন কোনও স্মৃতি মনে পড়ে?
উত্তর: অবশ্যই। ড্রেসিংরুমের কথা সব সময় মনে পড়ে। বিশেষ করে মাঠে খেলার পর ড্রেসিং রুমে ফিরে গিয়ে কত নামি-দামি ফুটবলারদের সঙ্গে বসে সেদিনের খেলা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেতাম। সে সব কোনওদিন ভোলার নয়।
প্রশ্ন: আজ পর্যন্ত বিকাশ নার্জিনারির কাছে তাঁর জীবনের সেরা খেলা কোনটা?
উত্তর: সিনিয়র ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে মহামেডান এসির বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম ম্যাচ। যে ম্যাচে আমি তিন গোলের হ্যাটট্রিক করি।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে আপনি ফুটবল থেকে খানিকটা দূরে চলে গিয়েছেন শোনা যায়। কেন?
উত্তর: একে বারেই না। এ বছর হয়তো এখনও পর্যন্ত আমি কোনও ক্লাবে সই করিনি। তবে আমি নিয়মিত অনুশীলন করি। একটা কথা আপনাকে আগেও বলেছিলাম। আমি গরিব ঘর থেকে উঠে আসা ফুটবলার। ফলে শুধুমাত্র প্রফেশনাল ফুটবলার হিসাবে নিজের লক্ষ্য ঠিক করতে পারাটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাহলে হয়তো আরও অনেক দূর এগোতে পারতাম। কিন্তু আমাদের মতো পরিবারে একটা চাকরিও খুবই আবশ্যিক। বাবা-মাকে দেখাও তো আমার কর্তব্য।
প্রশ্ন: আপনার অবগতির জন্য জানাই, আলিপুরদুয়ারে কলকাতার বড় ফুটবল ক্লাবের ফ্যান ক্লাব ছাড়াও অনেক ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ে উঠেছে। যাতে যোগ দিয়ে অনেকেই ভবিষ্যতে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
উত্তর: ফুটবলের প্রতিভা আলিপুরদুয়ারে অনেক আছে। কিন্তু কেন জানিনা, সেখানকার উঠতি প্রতিভাদের অনেককেই খানিকটা ঘরকুনো (হোম সিক) হয়ে থাকতে দেখেছি। সেটা তাদের কাটাতে হবে।
প্রশ্ন:আলিপুরদুয়ারকে নিয়ে আপনার কোনও ভাবনা?
উত্তর: ভবিষ্যতে আলিপুরদুয়ারে একটা ফুটবল অ্যাকাডেমি খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। হয়তো খুব দ্রুত সেই অ্যাকাডেমি খুলতে পারব না। তবে যেদিনই খুলি না কেন, আমার লক্ষ্য থাকবে নিজের জেলার উঠতি ফুটবল খেলোয়াড়দের খেলা শেখানোর পাশাপাশি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বুঝিয়ে তাঁদেরকে আমার থেকেও অনেক উঁচু জায়গায় নিয়ে যাওয়া। তবেই না মনে হবে, আমি আমার জেলার জন্য সামান্য কিছুটা হলেও করতে পেরেছি।