শনিবার ম্যাচ শেষে দুই অধিনায়ক।
সকালে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ খুলতে না খুলতে চমক! পেজ ওয়ানে পাতা জোড়া করে হঠাৎ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে ক্যাপশন— আসুন পা বাড়াই ঢাকার ভবিষ্যতের দিকে!
আসলে এটা প্রথম পাতা নয় খবরের কাগজের ভাষায়— কভার অন কভার। প্রথম পাতাকে জড়িয়ে বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশের রাজধানীতে উত্তরা রূপায়ণ সিটি নামক আবাসন প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছেন সৌরভ। পরশু এ জন্য ঝটিতি বারো ঘণ্টার ঢাকা সফর করে গেলেন।
শনিবার রাত্তিরটাও শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে কাটিয়ে গেলে সৌরভ নির্ঘাৎ সম্পূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া একটা আবাসন প্রকল্পের সাবেকি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিজেকে দেখতে পেতেন। টিম ইন্ডিয়ার আবাসন প্রকল্প।
ভারতীয় ক্রিকেটমহলে একটা আড্ডা অন্তহীন ভাবে চলে যে তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বকালের সেরা দল খেলানো গেলে কপিলের টিমে কী কী পরিবর্তন আসত?
সৌরভ যখন সেই দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সময় বলতেন, কপিল ছাড়া আর কাউকে রাখতাম বলে মনে হয় না। বাকিটা আমার টিম, তখন অনেকে শিউরে উঠতেন। শনিবার রাতের মীরপুর দেখার পর মনে হচ্ছে সৌরভের তৈরি সেই টিমেও এ বার দু’টো পরিবর্তন এখুনি না করলে নয়। একটা তো অনেক আগেই প্রমাণিত— মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আর একজন ফের দেখালেন তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতের সর্বকালের সেরা ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টি কোনও দলই হবে না। তিনি অবশ্যই বিরাট কোহলি!
আউট হয়ে কাল তর্ক করার জন্য কোহলি এ দিন ম্যাচ ফি-র তিরিশ পার্সেন্ট জরিমানা হারাতে পারেন কিন্তু মীরপুর ম্যাচ থেকে তাঁর আয় এত বেশি যে, ওই জরিমানায় বয়েই গেছে। ভারত তো আগেই কব্জায় ছিল। এ বার পাকিস্তানেরও দিল জিতে নিয়েছেন কোহলি। অথচ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের পছন্দের তালিকায় তিনি কখনও নন। দু’বছর আগে ঢাকার মাঠেই তাঁদের সঙ্গে উত্তপ্ত তর্কে জড়িয়েছিলেন। এর পর পাক ড্রেসিংরুম একাধিক বার বলেছে, ইন্ডিয়ান টিমের ভদ্রলোক হল ধোনি। সেকেন্ড লোকটা নয়। সেই মতামত বদলেছে কি না জানি না, কিন্তু না বদলালেই বা কী এসে যায়? ক্রিকেটার তো মাত্র এগারো জন। পুরো স্কোয়াড ধরলে চোদ্দো। পাক জনগণের পাশে সেই সংখ্যাটা কী।
লাহৌর এবং করাচিতে রোববার ফোন করে জানা গেল টিভিতে রাত্তিরে ম্যাচ শেষে লাথি মেরে ভাঙা, কুশপুতুল জ্বালানো এবং টিভির ফোন-ইনে ক্রিকেটারদের গালাগাল ছাড়াও আর একটা কাজ করেছে পাক জনতা। কোহলির জয়গান। কোহলি যে আমেরকে বাহবা দিয়েছেন এবং ম্যাচের মধ্যেও তাঁর প্রশংসা করছিলেন সেই ফুটেজ বারবার স্লো করে দেখিয়েছে ও দেশের টিভি চ্যানেল। পাক বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার আগা আকবর টিমের সঙ্গে এশিয়া কাপে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট টেবলে এবিপিকে বলছিলেন, ‘‘আমরা মুগ্ধ কোহলির সৌজন্য দেখে। গোটা পাকিস্তান তারিফ করছে।’’
একটা সময় পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা বলতেন সচিন দাও কাশ্মীর নাও। মীরপুরে একটা আপাতগুরুত্বহীন টি-টোয়েন্টি ম্যাচ সেটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সময়ের আধুনিক ভাষায়— কোহলি দাও। কাশ্মীর নাও।
এক মাঠ। এক টুর্নামেন্ট। এক প্রতিপক্ষ। কী করে দুই ক্রিকেটারের জীবনে পর্যায়ক্রমে পূর্ণিমা আর অমাবস্যার অবস্থান বদলে দিতে পারে ভেবে আশ্চর্য লাগছে। তিনি কোহলি সে দিন ছিলেন শেষ ওভারের দু’টো ছক্কায় হেরে যাওয়া হতমান ভারত অধিনায়ক। আর তিনি শাহিদ আফ্রিদি দুর্ধর্ষ জোড়া ছক্কায় ভারত-জয়ী মহাবীর।
জাভেদ মিয়াঁদাদ তো তবু শারজার শেষ বলে ছক্কার ব্যাট বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন। বেঙ্গসরকর যতই বলুন যে সাত বার ওই ব্যাট বিক্রি করেছে আর আসলটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে, ঘটনা হল ব্যাট বিক্রি ছাড়া মোটা টাকা তোলা যাচ্ছিল না। আফ্রিদিকে সেখানে দ্রুত দিয়ে দেওয়া হয় পাঁচ কাঠা জমি।
উনি ছিলেন প্লেয়ার আফ্রিদি। ইনি অধিনায়ক। মনে রাখতে হবে এই আফ্রিদির উপর আশা-ভরসার পরিমাপ অনেক বেশি। আফ্রিদির এক নম্বর বোলিং ভরসা মহম্মদ আমের দেশের মানুষকে এক রাত্তিরে মজিয়ে দিয়েছেন। এমন চললে এশিয়া কাপের মধ্যেই জনমানসে তাঁর ভাবমূর্তির বিনা জামিনে মুক্তি ঘোষিত হয়ে যাবে। শুনলাম ইসলামাবাদে হোটেল থেকে করাচিতে স্ত্রী শানেইরাকে ফোন করেছিলেন ওয়াসিম আক্রম। বলেছেন, ‘‘তুমি প্রায় আফসোস করো যে আমায় খেলতে দেখোনি। এখুনি টিভি খোলো, এই ছেলেটাকে দেখো। বুঝবে আমি কেমন ছিলাম।’’
আমেরের শাপমোচন হতে পারে। আফ্রিদিকে ছুটকারা দিচ্ছে কে? পাকিস্তান টিমের মধ্যে আঙুল উঠেছে হাফিজ আর শোয়েব মালিকের দিকে। বলা হচ্ছে এঁরা বারবার ব্যর্থ হয়েও দলে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো টিমের আভ্যন্তরীণ মানচিত্র। তার বাইরে বৃহত্তর সমাজের খলনায়ক বনে গিয়েছেন আফ্রিদি।
যাঁর সম্পর্কে এক রাত্তিরে দেশের লোক বলতে শুরু করেছে, বয়সের কোনও গাছ-পাথর নেই। কবে খেলছে, কবে খেলা ছাড়ছে, কবে আবার ফিরছে আল্লাহ্ জানেন। নামী পাকিস্তানি ক্রিকেটলিখিয়ে ফোনে বললেন, ‘‘ওয়েবসাইট তো ঠিকই লিখেছিল। আফ্রিদি হল রেখাকে পাকিস্তানি উত্তর। দু’জনেই অনন্তযৌবনা। দশ বছর ধরে শুনলাম আফ্রিদির বয়স সতেরো। তার পর অনেক দিন থেমে থাকল তেইশে। গত পাঁচ বছর ধরে প্রায়ই রিটায়ার করছে, আবার রোজ ফেরত আসছে। ক্যারেক্টার বটে।’’
গদ্দাফি স্টেডিয়ামে এ দিন পাক বোর্ডের আভ্যন্তরীণ জরুরি আলোচনায় কেউ কেউ বলেছেন মিসবা-উল-হককে টিমের নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন করে দিলে কেমন হয়? বক্তব্যের পিছনে যুক্তি হল, মিসবা বিয়াল্লিশ বছরে ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টি খেলবেন না। কিন্তু তাঁর ঠান্ডা মাথাটা ড্রেসিংরুমে দরকার হয়ে পড়েছে। সেন্টিমেন্ট হল আর একটা ইমরান পাওয়া যাবে না। কিন্তু মাইক ব্রিয়ারলি খুঁজতে দোষ কী?
টিমের সঙ্গে জড়িত একজন আবার দেশে রিপোর্ট দিয়েছেন, গোটা পাকিস্তান কাঁদছে। অথচ এরা কাল রাত্তিরে ডিনার খাওয়ার সময় এত নর্ম্যাল যেন কিছুই ঘটেনি। টাকা রোজগার করে করে কি এদের এমন হয়ে গেল যে ইন্ডিয়া ম্যাচ কী বস্তু ভুলে গিয়েছে?
পাকিস্তান শিবিরে একটা রাত্তিরের হারে এমন ভূকম্পন দেখে অবাকই লাগছিল। রিখটার স্কেলে এর চেয়ে বেশি মাত্রার কম্পন অতীতে ইমরানের দেশ সহ্য করেছে। এই অবস্থা থেকেও এশিয়া কাপ জয় সম্ভব। সবে তো প্রথম ম্যাচ হল। যতই বাংলাদেশ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলুক বাকি তিন ম্যাচ জিতলে তো পাকিস্তানই ফাইনাল খেলবে। অথচ হতাশার বারুদে যেন গোটা টিম সমর্পিত।
সহকারী ম্যানেজার বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলে পাঁড় ক্রিকেটভক্ত নয় তবে মোটামুটি খবর রাখে। সে আজ ফোনে বলল, আব্বা আমরা ইমরান খানের আমলে ছিলাম ডেঞ্জারাস টিম। পৃথিবীর সবাই আমাদের ভয় পেত। তার পর একধাপ নেমে হলাম আনপ্রেডিক্টেবল। যখন-তখন, যাকে-তাকে হারিয়ে দিতে পারি। এখন আমরা সেটাও নই।’’
ঢাকাতেই দু’বছর আগে শোনা একটা মন্তব্য দ্রুত মনে পড়ে গেল। জাহির আব্বাস বলেছিলেন এখনকার ভারতীয় টিম ডিরেক্টরকে। ‘‘রবি, আমি বব উলমারের মৃত্যু রহস্য বার করে ফেলেছি।’’
রবি শাস্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে। তখনকার পাক টিমের ক্রিকেট-ডিরেক্টর জাহির বললেন, ‘‘পদে এসে দেখছি মৃত্যুটা তো খুব স্বাভাবিক। বেচারির হার্ট বারবার ইন্ডিয়ার ম্যাচের ধকল আর হার নিতে পারেনি।’’