কত তেরঙ্গা পতাকা বৃহস্পতিবার ছিল রিওসেন্ট্রোর ওই সবুজ কোর্টটার আশেপাশে? ছয়, সাত? দশ-বারো-ষোলো কুড়ি? না, না গোনা যাচ্ছে না। অগুনতি।
সাইনা নেহওয়ালের পর ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের নতুন সূর্যোদয়ের দিনে কতগুলো হাত সেই তাপ পোহাতে এসেছিল? পুসারালা বেঙ্কট সিন্ধুর এক-একটা পয়েন্টের জন্য নিজেদের যথাসর্বস্ব বাজি রাখতে তৈরি এই তেরঙ্গাময় গ্যালারি— এটা রিও না হায়দরাবাদ?
হিসেবনিকেশ তো পরের কথা, সব গুলিয়ে যাচ্ছে! এখন দু’চোখ ভরে দেখার সময়। স্বপ্ন দেখার সময়। জাপানি বোমাকে নির্বিষ করে সোনার পদকের দিকে পা বাড়ানো আপাত শান্ত মেয়ের তীব্র জয়োল্লাস দেখার সময়। যাঁকে এখন যোগ্য সঙ্গত করছে ওই গ্যালারি— ‘সিন্ধু, হামারা সিন্ধু, ইন্ডিয়া কা সিন্ধু’ স্লোগানে।
মেয়েদের ব্যাডমিন্টনে সিঙ্গলসে পদক আজ নিশ্চিত হয়ে গেছে গোপীচন্দের ছাত্রীর। কিন্তু গত কাল আর আজ, পরপর দু’দিন সিন্ধুর দাপট দেখে অনেকেই বলছেন, রুপো-টুপো নয়, সোনার স্বপ্ন দেখার সাহস করা মোটেই অন্যায় হবে না। গত কালের লড়াইটা ছিল কামব্যাকের। আর আজ যেন তাঁরই দিন! দ্বিতীয় গেমে তো একটা সময়ের পর থেকে সিন্ধুরই টানা বারো পয়েন্ট। নাগাড়ে। অন্তত চার বার মাটিতে আছড়ে পড়লেন জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বী নোজোমি ওকুহারা।
কী ভীষণ প্রতীকী! নোজোমির জন্য রঙিন সাজে সেজে এসেছিলেন জাপানি সমর্থকেরা। যাঁদের একাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সিন্ধুর চোখে তাঁরা আলো ফেলছিলেন। সতর্ক করেও থামানো যায়নি। সিন্ধু থামিয়ে দিলেন। মাথা নিচু করে জাপানি কায়দায় অভিবাদনে। এই যে মাটিতে র্যাকেট রেখে মাথা নত করা, এ-ও তো তাঁর কোচের ‘ব্র্যান্ড’!
প্রথম গেমটায় টক্কর হয়েছিল ভালই। কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত— দুই যুযুধানই প্লেসিংয়ে পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ১-১, ৩-৪, ৫-৩, ১২-১০... ভালই চলছিল র্যালি। শেষ পর্যন্ত সিন্ধু যখন ২০-১৯ এগিয়ে, তখনও কী অসম্ভব ধুকপুকুনি গ্যালারিতে! সিন্ধু কিন্তু স্থির। যেন শিকার ধরতে ঝাঁপানোর আগে বাঘিনি। গেমটা ২১-১৯ জিতেই চলে এলেন কোচের কাছে। চলল খানিক পরামর্শ। তার পর আবার কোর্টে।
ওকুহারাকে ধরাশায়ী করে ফাইনালে সিন্ধু। ছবি: রয়টার্স।
দ্বিতীয় গেমে ক’টা ভুল প্লেসিংয়ে ৭-৮ পিছিয়ে গেলেন সিন্ধু। গোপী তখন বারবার অভয় দিচ্ছিলেন, ‘ম্যাচ তোমার হাতে।’ ১১-১০ হওয়ার পরে স্বপ্নের দৌড় শুরু। র্যালিতে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন নোজোমিকে। জাপানি মেয়ে তাঁর শট ফেরাতেই আছড়ে পড়ছিল স্ম্যাশ। ১০ থেকে আর পয়েন্ট বাড়াতে পারেননি নোজোমি। সিন্ধু জিতলেন ২১-১৯, ২১-১০।
গত কাল দুরন্ত খেলেও ছিটকে গিয়েছিলেন গোপীর আর এক ছাত্র কিদাম্বি শ্রীকান্ত। উচ্ছ্বসিত শ্রীকান্ত বলছিলেন, ‘‘সিন্ধুর স্ম্যাশ-অস্ত্রটাই আজ ওকে জিতিয়ে নিয়ে গেল। অন্তত দেড় ফুট কম উচ্চতার জাপানি মেয়ের সঙ্গে যেমন খেলা উচিত ছিল, ঠিক সে রকমই খেলেছে ও। দুর্দান্ত!’’ উচ্ছ্বসিত গোপীচন্দও। সিন্ধু এ দিন বারবার বলছিলেন, ‘‘গোপী স্যার যে ভাবে আমার কিছু খারাপ পয়েন্ট নষ্টের সময় পিছন থেকে ‘কাম অন’ বলে অভয় দিচ্ছিলেন, সেটাই আমাকে বাড়তি মনোবল জুগিয়েছে।’’ আর ছাত্রী সম্পর্কে গোপীর মূল্যায়ন? ‘‘ওর মধ্যে আরও ক্ষমতা আছে। আজ যে ভাবে বলেছিলাম, ঠিক সে ভাবে খেলেছে।’’
সিন্ধুকে গেটেই জড়িয়ে ধরলেন নীতা অম্বানী। দেখা গেল প্রাক্তন আইওএ সচিব রণধীর সিংহকেও। নীতা বলছিলেন, ‘‘ও অসাধারণ খেলেছে। গর্বিত করেছে আমাদের।’’ পাল্টা সিন্ধুকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমার স্বপ্ন এখনও শেষ হয়নি। এখনও একটা ম্যাচ বাকি।’’ নীতা তাঁকে বললেন, ‘‘আমরা সবাই কাল আসব তোমার জন্য।’’ ভারতীয় শেফ দ্য মিশন বা কোনও কর্তাকে অবশ্য এ দিন দেখা যায়নি। পদকের লড়াই ছেড়ে তাঁরা নরসিংহ যাদবকে নিয়ে ব্যস্ত। কী যে এক ডোপিং নিয়ে হয়রানি চলছে!
শুক্রবার সোনার লড়াই স্পেনের ক্যারোলিন মারিনের বিরুদ্ধে। সিন্ধুর সর্বশেষ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে তাঁর উচ্চতাটা একটু বেশি। তা ছাড়া তিনি বাঁ-হাতি। এই দু’টো চ্যালেঞ্জেরই মোকাবিলা করতে হবে সিন্ধুকে। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব তো নয়! গোপীর ছাত্রী বলছেন, ‘‘স্যারের নির্দেশ মতো আমি ম্যাচ ধরে ধরে এগিয়েছি। আমি জানি, লড়তে হয় প্রত্যেকটা পয়েন্টের জন্য। আমার লক্ষ্য সোনা। কথা দিচ্ছি, সবটুকু উজাড় করে খেলব।’’