বিরাট কোহালির পরে আর. অশ্বিন। ব্যাটের পরে বল। নাগপুরে রেকর্ড ভেঙে পড়ছে তাসের ঘরের মতো। সত্যিই কি ভিভ রিচার্ডসের চেয়ে ভাল কোহালি? বা ডেনিস লিলির চেয়ে বল হাতে বেশি ধ্বংসাত্মক অশ্বিন?
আরও গভীরে গিয়ে নানা পরিসংখ্যান ঘেঁটে অনুসন্ধান করতে বসলে পাওয়া যাচ্ছে অন্য ছবি। বিশেষজ্ঞরা নিজের দেশের অনুকূল পিচ আর পরিবেশের চেয়ে বিদেশে গিয়ে ভাল খেলাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সুনীল গাওস্কর সর্বকালের সেরাদের একজন কারণ, তাঁর ৩৪টি সেঞ্চুরির ১৮টি এসেছে বিদেশের মাটিতে। তার মানে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি সেঞ্চুরি তিনি করেছেন দেশের বাইরে গিয়ে। এর মধ্যে ৭টি সেঞ্চুরি অগ্নিযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধে করা। গাওস্করের চারটি ডাবল সেঞ্চুরির দু’টি বিদেশের মাঠে। পোর্ট অব স্পেনে ঐতিহাসিক ২২১ এবং ওভালে ২২০।
রাহুল দ্রাবিড়ের টেস্ট ব্যাটিং গড় ৫২.৩১। বিদেশে তাঁর গড় আরও বেশি— ৫৩.০৩। তাঁর ৩৬টি টেস্ট সেঞ্চুরির ২১টি বিদেশের মাটিতে। পাঁচটি ডাবল সেঞ্চুরির তিনটি বিদেশে। অ্যাডিলেডে ২৩৩ এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ২৭০-এর দৌলতে ভারত দু’টি টেস্টেই জেতে। আর ওভালে দ্রাবিড়ের ২১৭ দলকে রক্ষা করে। সচিন তেন্ডুলকরের ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরির ২৯টি বিদেশে। ঘরের বাইরে সচিনের ব্যাটিং গড় ৫৪.৭৪।
আরও পড়ুন: একদিনের সিরিজে বিশ্রামে বিরাট, অধিনায়ক রোহিত
ভারতের স্বর্ণযুগের স্পিনারদের মধ্যে এরাপল্লি প্রসন্নর ১৮৯ উইকেটের ৯৪টি বিদেশে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াতেই তিনি ৮ ম্যাচে পেয়েছেন ৩১ উইকেট। নিউজিল্যান্ডে ৭ ম্যাচে ৩৫ উইকেট। মনে রাখা দরকার, প্রসন্নর সময় বিদেশ বলতে বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কা ছিল না।
অশ্বিনের ৩০০ উইকেটের মধ্যে ৮৪টি বিদেশে। মানে মোট শিকারের ২৮ শতাংশ বিদেশের মাটিতে। প্রসন্নর ক্ষেত্রে যেটা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। তা-ও আবার অশ্বিন বাংলাদেশে পেয়েছেন ৫ উইকেট, শ্রীলঙ্কায় ৩৮ উইকেট। সেটা বাদ দিলে উপমহাদেশের বাইরে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৪১। অস্ট্রেলিয়ায় এখনও পর্যন্ত ৬টি টেস্ট খেলে অশ্বিন পেয়েছেন ২১ উইকেট। গড় ৫৪.৭১। প্রসন্নর সেখানে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বোলিং গড় ৩১.১২। অস্ট্রেলীয়রা ঐতিহাসিক ভাবে অফস্পিনের বিরুদ্ধে দুর্বল। জিম লেকারের ইনিংসে ১০ উইকেট এবং ম্যাচে ১৯ উইকেট ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। সেখানেও দেশের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেননি এখনকার অফস্পিনার।
প্রসন্নকে বরাবর সেরা স্পিনার মনে করেছেন ইয়ান চ্যাপেল। স্যার গ্যারি সোবার্স বলেছিলেন, তাঁর দেখা সেরা লেগস্পিনার সুভাষ গুপ্তে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপূঞ্জে ৫টি টেস্ট খেলে ২৭ উইকেট নিয়েছিলেন গুপ্তে। তিন বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন। টেস্টে মোট ১২বার ইনিংসে পাঁচ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছিলেন গুপ্তে। ছ’বার দেশের মাঠে, ছ’বার বিদেশে। অশ্বিনের সেখানে ২৬বার ইনিংসে পাঁচ বা তার বেশি শিকার হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে ২০টিই দেশের মাঠে। বাকি ছ’বারের মধ্যেও তিনবার শ্রীলঙ্কায়, দু’বার ধুঁকতে থাকা এখনকার এই ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে, একবার বাংলাদেশে।
টেস্টে দ্রুততম তিনশো উইকেটশিকারি হিসেবে সোমবার ডেনিস লিলিকে টপকে নতুন বিশ্বরেকর্ড করলেন অশ্বিন। অস্ট্রেলীয় পেস-কিংবদন্তি তিনশো উইকেটে পৌঁছেছিলেন ৫৬ টেস্টে। অশ্বিনের লাগল দু’টি টেস্ট কম। অশ্বিন-ভক্তরা পাল্টা তর্ক তুলতেই পারেন, ভারতের স্পিন-সহায়ক পিচে এসে কোথায় উইকেট নিলেন লিলি?
ভারতের স্বর্ণযুগের চার স্পিনারের বিদেশে বোলিং গড়ের পাশাপাশি অশ্বিনের বিদেশের বোলিং গড় ভাল দেখাতে পারে। জরুরি তথ্য হচ্ছে, অশ্বিনের ক্ষেত্রে বিদেশ বলতে শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের হিসেবও রয়েছে। বেদী, প্রসন্নরা উপমহাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে শুধু পেয়েছেন ইমরান খান, জাহির আব্বাসদের পাকিস্তানকে। ক্রিকেটে প্রযুক্তির আগমনে এখন প্রত্যেক দলের সঙ্গে ভিডিও অ্যানালিস্ট চলে এসেছেন। অত্যাধুনিক বিশ্লেষণ আর ঘন-ঘন একই ব্যাটসম্যানের সামনে পড়তে হলে বেদী, চন্দ্র, প্রসন্নর রহস্য আর রহস্য থাকত কি না, সেই তর্ক থাকছে।
তবু দেশে আর বিদেশে সাফল্যের ব্যবধানের তর্কটা থাকবে। শেন ওয়ার্নের ৭০৮ উইকেটের ৩৬২টি বিদেশের মাঠে। অর্থাৎ, ৫১ শতাংশ শিকার বাইরে। ওয়ার্ন ইনিংসে পাঁচ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন ৩৭বার। তার মধ্যে ২০বার বিদেশের মাঠে। মুথাইয়া মুরলীধরনের ৮০০ টেস্ট উইকেটের ৩০৭টি বিদেশের মাটিতে। ৬৭বার ইনিংসে পাঁচ বা বেশি উইকেটের মধ্যে ২২বার বিদেশে।
এশীয় উপমহাদেশে বোলিং স্ট্রাইক রেট, অর্থাৎ বল পিছু উইকেটের হিসেবেও অশ্বিনের চেয়ে এগিয়ে একমাত্র ইমরান খান। কিন্তু সেটাও শুধুই উপমহাদেশে হওয়া ম্যাচের ভিত্তিতে। সর্বকালের সেরাদের তালিকায় থাকতে গেলে দেশের মাঠের ঘূর্ণি পিচ না পেলেও যে তিনি কামাল করতে পারেন, সেটা দেখতে চাইবে ক্রিকেটবিশ্ব।