ক্যানবেরাতে সে দিন চতুর্থ ওয়ান ডে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে এক ভারতীয় সাংবাদিক রবি শাস্ত্রীর কাছে জানতে চাইছিলেন, ‘‘হু ইজ দ্য শ্রিঙ্ক ইন দিস টিম।’’
ধোনির ভারত তখন সিরিজে ০-৩ পিছিয়ে এবং সবাই ধরে নিচ্ছে আড়ং ধোলাই হবে। সেটা মাথায় রেখেই হাল্কা ব্যঙ্গ, ভারতীয় দলের মনোবিদটা কে? তাঁকে এ বার কাজে লাগাও। শাস্ত্রী চোখের পাতা না কাঁপিয়ে উত্তর দেন, ‘‘দ্য নেম ইজ শাস্ত্রী। হি ইজ দ্য শ্রিঙ্ক।’’
সফর শেষ হওয়ার পর শাস্ত্রী আর সেই মুম্বইয়ের সাংবাদিককে খুঁজে পাননি। পেলে কথোপকথনের পরবর্তী সিকুয়েল অবশ্যই উপভোগ্য হত।
শনিবার মুম্বই থেকে ভারতীয় ক্রিকেটমহলের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘‘আপনাদের মিডিয়াকে বলিহারি। কোনও সাদা চামড়ার লোক কোচ হয়ে এই পারফরম্যান্স দেখালে আপনারা তাকে মাথায় তুলে রাখতেন। রোজ প্রচ্ছদকাহিনী বেরোতো। যেহেতু ভারতীয় কোচ। মিডিয়া তাকে নম্বর দেবে না।’’
শাস্ত্রী এটা শুনলে অনিবার্য ভাবে দ্রুত সংশোধন করে দিতেন, ‘‘ভাই কোচ না। টিম ডিরেক্টর। ডেসিগনেশন ভুল করবেন না।’’
সাফল্য হোক বা ব্যর্থতা। রবি শাস্ত্রী সব সিজনে এক রকম। সেই জিটিইউ ক্লাবের সদস্য। গির গয়ে ভি টাং উপর। এখন অবশ্য গির গয়ের কোনও ব্যাপার নেই। শাস্ত্রীয় ছায়ায় ভারত টেস্টে পাঁচ নম্বর থেকে এক নম্বরে এসেছে। ওয়ান ডে-তে চার নম্বর থেকে দুই তে এসেছে। আর টি টোয়েন্টি-তে ছয় থেকে একে।
দুটো ফর্ম্যাটের ক্রিকেটে ভারত এখন বিশ্বসেরা। আর একটাতে দু’নম্বর। দেড় বছর আগের ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে ভাবতেই কেমন লাগে। সে বারের জুনে যখন তারা বিধ্বস্ত হয়ে ইংল্যান্ডের কাছে টেস্ট সিরিজ হারছিল তখন কোচ ছিলেন ডানকান ফ্লেচার। এমনই অমাবস্যা এসে হাজির হয় ভারতীয় ড্রেসিংরুমে যে পূর্ণিমা বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে কেউ ভাবতে পারছিল না। গ্রেগ চ্যাপেল পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটে এটা সবচেয়ে অসহায় সময়কাল—২০১৪-র জুন-জুলাই।
নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন ঠিক এই সময়ে তাঁর কালিমালিপ্ত প্রশাসনিক জীবনের অন্যতম ধূর্ত চালটি দেন, শাস্ত্রীকে কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে।
এর আগে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের আমলে শাস্ত্রীকে এ হেন প্রস্তাব অন্তত তিন বার দিয়েছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। তাঁর শর্ত ছিল, ক্যাপ্টেন আজহারকেই রাখা হবে। কিন্তু তিন বছরের জন্য কোচ হবেন শাস্ত্রী।
শাস্ত্রী কিছু পাল্টা শর্ত আরোপ করায় প্রস্তাবটা মাঝ হুগলিতে তলিয়ে যায়। যখন তিনি এমনতর সব প্রস্তাব দিচ্ছেন যে দল নির্বাচনে আজহার নয় তাঁকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তখন মুম্বইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা নিরস্ত করতে যান। বলেন, এই সব করলে কিন্তু আজহার তোকে খেয়ে ফেলবে। তুই কোচ হবি এবং স্যাকড হয়ে যাবি। শাস্ত্রী জবাব দিয়েছিলেন, তাতে সমস্যা নেই। ড্রেসিংরুম অন্তত জানবে এই লোকটাকে কেন যেতে হল? সেই উত্তর থেকে যে সম্মান পাওয়া যাবে সেটা পেলেই আমার চলবে।
উনিশ বছর পরের যা পরিস্থিতি তাতে অবশ্য ড্রেসিংরুম থেকে চলে যাওয়ার কোনও কাহিনী নেই। ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অপ্রত্যাশিত খারাপ ফল না করলে টিম ডিরেক্টর শাস্ত্রীর দীর্ঘ ছায়া এখনই অন্তর্হিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ড্রেসিংরুমে তিনি রবি ভাই এবং অবিসংবাদী বড়দা। যখন একসঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন তখন সুনীল গাওস্কর একবার বলেছিলেন, ‘‘টিমে উত্তর-পশ্চিম ভেদাভেদ আছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু রবি টিমের একমাত্র যে মুম্বই এবং দিল্লি দু’শহরের ছেলেদের কাছেই সমান গ্রহণযোগ্য।’’
আধুনিক ভারতীয় ড্রেসিংরুমেও অদৃশ্য দুটো ভাগ। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী উত্তর আর পূর্ব। শিবিরের নেতাদের নাম অনুযায়ী ধোনি আর কোহলি। চোরাস্রোতের যা শিরশিরানি তাতে বহুদিনই সিস্টেম কোলাপস করে যাওয়ার কথা। অথচ ওয়াই ফাই সিগন্যাল সহজে আসার মতোই যে ফুর্তির গান বাজছে, চোরা বিভেদের ফাটল বড় হচ্ছে না তার একমাত্র কারণ শাস্ত্রী।
ভারতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত একজন বলছিলেন, ‘‘রবি ভাইয়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ম্যান ম্যানেজমেন্ট। কাউকে উনি প্রকাশ্যে বকাবকি করেন না। আলাদা করে একান্তে ডেকে নেন। একজন জানতেও পারে না অন্য জন কী কড়কানি খেল।’’ শাস্ত্রীর অধীনে সবচেয়ে অগৌরবজনক পারফরম্যান্স বাংলাদেশে ওয়ান ডে সিরিজ হেরে আসা। কিন্তু তার সবচেয়ে পরীক্ষা হিসাবে হাজির হয় গল টেস্টের হার। গত স্বাধীনতা দিবসের দিন গলের মাঠে হাতে থাকা টেস্ট ম্যাচ কোহলির ভারত সমর্পণ করে আসে।
শোনা যায়, সে দিন শ্রীলঙ্কার মাঠেই পোস্টমর্টেম মিটিং ডেকেছিলেন শাস্ত্রী। ছেলেদের বলেন, ‘‘এই যা ম্যাচ হেরেছ এর রেশ জীবনে কখনও ভুলবে না। কিন্তু আমি চাই না হোটেলের ঘরে গিয়ে তোমরা ম্যাচটার কথা মনে করো। আর আরও বেশি গুম হয়ে যাও। যাকে যা বলার, যার যা সমালোচনা করার এখুনি করো। সবার সামনে করো। করে সিস্টেম থেকে হারটা বের করে দাও। রাত্তিরে আমরা আবার সবাই মিট করছি। সেখানে বাকি দুটো টেস্ট জেতা নিয়ে কথা বলব।’’
ভারত সেই সিরিজ জেতে ২-১। আজও শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গ উঠলে ক্রিকেটাররা শাস্ত্রী-কোহলির গল-হার পরবর্তী মনোভাবকে প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন।
তাঁরা হয়তো টিমের মধ্যে থাকেন বলে বোঝেন না। শাস্ত্রীয় আসল প্রভাব কিন্তু শ্রীলঙ্কার হার পরবর্তী মনোভাব নয়। আসল প্রভাব হল ধোনি-কোহলি সম্পর্ক অক্ষত রেখে যাওয়া।
পরিসংখ্যান হিসাবে শাস্ত্রীর আমলে টেস্ট রেকর্ড ৬-৩। ওয়ান ডে তে ২৩-১৫। টি-টোয়েন্টিতে ৩ জিত ৩ হার। টিম যে অবস্থা থেকে নিয়েছিলেন এবং যেখানে নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে ফারাক স্ট্যালিনের রাশিয়া আর গোর্ভাচেভের রাশিয়ার। কিন্তু ঘুরেফিরে তাঁর কোচিং নেটওয়ার্কের আসল সিগন্যাল ওই একটা বিন্দুর ওপর স্থাপিত। ড্রেসিংরুম যেন সুখী থাকে। হাল্কা যে বারুদগুলো এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছে সেগুলোকে যেন চাপা দেওয়া থাকে।
কোহলি শুরু থেকেই তাঁর ফেভারিট ছেলে। দু’জনের ক্রিকেটীয় মানসিকতায় অজস্র মিল। আউট অব ফর্ম কোহলি নতুন টিম ডিরেক্টরের আমলে সিংহাসন ফেরত পান। টেস্ট অধিনায়ক নির্বাচিত হন। দু’জনের বোঝাপড়ার ঘনত্বই আলাদা। ঠিক একই সময়ে ধোনি তাঁর রাজ্যপাট নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। নিজের পারফরম্যান্স উল্লেখযোগ্য হয়নি। টিম বাংলাদেশে সিরিজ হেরেছে। অন্য যে কোনও টিম ডিরেক্টর হলে দ্রুত সে ধোনি-বিদায় এপিসোডে নেমে পড়ত।
শাস্ত্রী অফ স্টাম্পের বাইরের বিষাক্ত ডেলিভারি ছাড়ার দক্ষতায় এই সমস্যাটা ম্যানেজ করেছেন। কমেন্ট্রি বক্সে বসে যেমন ধোনিকে প্রশংসা করতেন, আজও তাই করছেন। শুক্রবারও বলেছেন ধোনিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ডিকশনারি খুলতে হবে। খুলে ‘রেসপেক্ট’ শব্দের মানে বের করতে হবে। তা ধোনি নিশ্চয়ই চমত্কৃত হয়ে দেখছেন এই লোকটা শুধু শ্রীনিবাসন আমলে আমায় ভাল বলেনি। মনোহর জমানাতেও ভাল বলে যাচ্ছে। তা হলে এ শুধু কোহলির বন্ধু নয়। আমারও।
দিল্লি ক্রিকেটমহলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলছিলেন, ‘‘গ্যারি কার্স্টেনকে আপনারা এত মাথায় তুললেন। গ্যারি কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় টিম নিয়ে যায়নি। ইংল্যান্ডেও না। তা ছাড়া ও কী টিম পেয়েছিল সেটা ভেবে দেখবেন।’’
যথাসম্ভব কম কথায় অস্ট্রেলিয়ায় নিরঙ্কুশ টি-টোয়েন্টি জয়ের পর অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটমহলে শাস্ত্রীয় মহিমা আলোকিত হচ্ছে।
কিন্তু শাস্ত্রী নিজে অবশ্যই জানেন তাঁর আসল পরীক্ষা হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ওয়ান ডে বিশ্বকাপে তাঁর টিম যতই টানা সাত ম্যাচ জিতুক, এ বার ভারতের মাঠে খেলা। আরও নগ্নভাবে যাচাই করা হবে তাঁর টিমের পারফরম্যান্স। হাড়িকাঠের সবচেয়ে কাছাকাছি যদি তাঁর অধিনায়ক ধোনি থেকে থাকেন, কে বলতে পারে লতায়পাতায় ডিরেক্টরকেও টেনে আনা হবে না? ভারতীয় ক্রিকেট জনতা বিশ্বকাপের সময় যুক্তি বোঝে না। অতীত পরিসংখ্যান বোঝে না।
১৫ মার্চ নাগপুরে তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ড্রেসিংরুমে বসে শাস্ত্রী নিজের জন্য মাঠে আম্পায়ারের আওয়াজটাই অস্ফুটে শুনবেন— প্লে!