প্রত্যয়ী: অলিম্পিক্স থেকেও পদক আনার লক্ষ্যে অতনু-দীপিকা। ফাইল চিত্র।
বাংলার বর আর ঝাড়খণ্ডের কনে। এই দম্পতির বিশেষত্ব হল দু’জনেই বিশ্বজয়ী তিরন্দাজ। বঙ্গসন্তান অতনু দাস ও ঝাড়খণ্ডের মেয়ে দীপিকা কুমারী মনে করছেন, মাত্র আট সপ্তাহেই পৃথিবী বদলে গিয়েছে অনেকটা। নেপথ্যে অবশ্যই বিশ্বজুড়ে করোনার নতুন সংক্রমণ।
শনিবার দুপুরে পুণের সেনাবাহিনীর অতিথি নিবাস থেকে অতনু বলছিলেন, ‘‘গুয়াতেমালার বিশ্বকাপে যাওয়া-আসার মাঝেই বুঝলাম কতটা কাঁটা বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে।’’ দীপিকাও ইতিবাচক মেজাজে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি যা-ই হোক, আমাদের প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি থাকতেই হবে। করোনার জন্যই সুইৎজ়ারল্যান্ডে স্টেজ টু বিশ্বকাপে যাওয়া হল না। প্যারিসে স্টেজ থ্রি বিশ্বকাপে নামতেই হবে। তাই ১৫ মে থেকে এক মাস অনুশীলনে ডুবে যাব। আমাদের মহিলা দলকে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র পেতেই হবে।’’
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে তিরন্দাজির ব্যক্তিগত ও দলগত রিকার্ভ বিভাগে ছাড়পত্র পেয়েছেন অতনু। মহিলাদের রিকার্ভে ব্যক্তিগত বিভাগে পদকের জন্য লড়াই করবেন দীপিকা। কিন্তু দলগত বিভাগে অতনুদের পুরুষ দল যোগ্যতা অর্জন করলেও এখনও বাকি ভারতীয় মহিলা দলের ছাড়পত্র পাওয়া। দীপিকাদের মহিলা রিকার্ভ দল অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র পেতে পাখির চোখ করছেন ২১-২৭ জুন প্যারিসে স্টেজ থ্রি বিশ্বকাপকে। কারণ, সেই প্রতিযোগিতা অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র আদায় করার শেষ সুযোগ। অতনু বলেন, ‘‘প্যারিসে মেয়েদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এখনও অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইটালি, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশ।’’ যোগ করেন, ‘‘কোনও কিছুই এখন নিশ্চিত নয়। গুয়াতেমালায় গিয়ে যা বুঝেছি এ রকম ভয়, আশঙ্কার সঙ্গে পারফরম্যান্স কখনও করিনি।’’
কী হয়েছিল গুয়াতেমালা সফরে? অতনু বলে চলেন, ‘‘এই সফরের আগেই আমাদের তিরন্দাজ দলকে করোনা প্রতিষেধকের দুই ডোজ টিকা (কোভিশিল্ড) দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৬ এপ্রিল যাত্রা করার দিন সকালেও আমরা বুঝতে পারছিলাম না, যেতে পারব কি না। কারণ পুরুষ কম্পাউন্ড দলের একজন করোনা সংক্রমিত হয়েছিল।’’ যোগ করেন, ‘‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারি, আমাদের রিকার্ভ দলের শিবির পুণেতে হয়েছিল। আর কম্পাউন্ড দলের শিবির হরিয়ানায় আয়োজিত হওয়ায়। কম্পাউন্ড দল তাই অনুমতি পায়নি।’’
বরাহনগরের প্রামাণিক ঘাট রোডে বেড়ে ওঠা ও বর্তমানে পূর্ব কলকাতার বাসিন্দা অতনুর কথায়, ‘‘দিল্লি থেকে গুয়াতেমালা ৪০ ঘণ্টার এই বিমানযাত্রায় খাওয়ার সময় ছাড়া আমাদের মুখাবরণ খোলার অনুমতি ছিল না। আর প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর স্যানিটাইজ় করা বাধ্যতামূলক ছিল। মাঝে আমস্টারডাম, পানামায় করোনা পরীক্ষা হয়েছে।’’ দীপিকার কথায়, ‘‘সবাই গুয়াতেমালায় আমাদের সাফল্য নিয়ে খুশি। কিন্তু আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল। হোটেল আর মাঠ ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না। প্রত্যেকের আলাদা ঘর। কেউ কারও ঘরে যেতে পারবে না। হোটেল থেকে মাঠ, মাঠের প্রবেশদ্বার প্রতিটি জায়গায় শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। আর তা জারি থাকছে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর (খেলায় সময়ে নয়)। এ ভাবে মনঃসংযোগ ধরে রাখাই যে কষ্টকর।’’
পাশ থেকে অতনু এ বার বলেন, ‘‘ফাইনালের আগে শুনি, যে ডাচ বিমান সংস্থার উড়ানে আমাদের ফেরার কথা ছিল, তারা পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। ওই চিন্তা নিয়েই আমি ও দীপিকা বিশ্বকাপে সোনা জিতেছি। দু’জন দু’জনকে কেবল বলে গিয়েছি, ভারতীয় দূতাবাস ও জাতীয় তিরন্দাজি সংস্থা একটা ব্যবস্থা করবেই। আমাদের এখন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবার নেই।’’
ফিরলেন কী ভাবে? দীপিকা বলেন, ‘‘একদিন বেশি থাকতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফরাসি বিমান সংস্থার উড়ানে ৮৬ ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে ভারতে ফিরেছি।’’ অতনুর কথায়, ‘‘গুয়াতেমালা থেকে পানামা। সেখানে দু’ঘণ্টার অপেক্ষা। তার পরে সেখান থেকে প্যারিস। সেখানে ২৩ ঘণ্টার অপেক্ষা। তার পরে সেখান থেকে বেঙ্গালুরু। কিন্তু সেখান থেকে পুণের উড়ান নেই। তাই অন্য উড়ান ধরে মুম্বই গিয়ে নামি। সেখান থেকে সড়ক পথে ফিরেছি। দুর্ভোগটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন!’’
ভারতের করোনা সংক্রমণের প্রাণকেন্দ্র মুম্বই বিমানবন্দরে নেমে ভয় করেনি? দীপিকা বলছেন, ‘‘করবে না ভয়? ট্যাক্সিতে বসে দলটা ভয়ে কাঁপছিল। নিজেরাই গাড়ির আসন ও শরীর স্যানিটাইজ় করতে করতে ফিরেছি।’’
ভারতের এই এক নম্বর তিরন্দাজ দম্পতি আশ্বস্ত তাঁদের পরিবারের সবার প্রতিষেধক নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কলকাতায় পরিবারের অনেকে এখনও প্রতিষেধক পাননি। সে কারণে চিন্তাও রয়েছে।
অতনু বলছেন, ‘‘চিন্তা তো অলিম্পিক্স নিয়েও। যদিও অলিম্পিক্স হবেই। বলছে আমার জাপানি তিরন্দাজ বন্ধুরা। ১৪ মে পর্যন্ত নিভৃতবাসে থাকব। তার পরে শুরু হবে এক মাসের প্রস্তুতি। সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা যোগাভ্যাস ও ধ্যান। আটটা থেকে ১২ টা পর্যন্ত তিরন্দাজি অনুশীলন। ফের সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে সাতটা তিরন্দাজি। তার পরে দৌড়, ফিটনেস বাড়ানোর প্রস্তুতি। এটাই টোকিয়োর জন্য নিত্যদিনের রুটিন।’’ যোগ করেন, ‘‘সঙ্গে থাকবে মন একাগ্র রাখার জন্য মনোবিদের পরামর্শ। কিন্তু সবার আগে প্রার্থনা, অলিম্পিক্স যেন হয়। না হলে, এই দু’র্দিনেও মন শক্ত রেখে আমাদের সব লড়াই ব্যর্থ হয়ে যাবে। বদলে যাওয়া পৃথিবীতেও অলিম্পিক্স পদকের স্বপ্ন দেখছি আমরা।’’