রোহিতরা কি পারবেন আজ এই মেজাজ ধরে রাখতে?
ক্রিকেটে এ হেন অনুশীলনের কোনও নাম নেই!
কাছাকাছি নামকরণ হতে পারে ‘টোয়েন্টি-টু ইয়ার্ডস ভিসুয়ালাইজেশন’। মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠ যেমন টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেটের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে চিরকালীন ইতিহাসে থেকে যাবে, তেমনই একটা মহা-স্তরে তিনি, ম্যাথু হেডেনও থেকে যাবেন মনশ্চক্ষে অনুশীলনের প্রক্রিয়াটা প্রথম চালু করার জন্য।
রাহুল দ্রাবিড় এরই অনুসরণ করেছেন পরে। কৌশলটা হল ম্যাচের আগের দিন উইকেটে ঢুকে পড়ে অনবরত শ্যাডো করা। তার পর নামগান শোনার ভঙ্গিতে পিচের পাশে শান্ত হয়ে বসে থাকা। ব্যাটসম্যান এই সময় নিজেকে একটা ‘জোন’-এর মধ্যে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কল্পনা করতে থাকে, এই পিচের ওপরেই সে ব্যাট হাতে কাল! ডিফেন্স করছে। অফ স্টাম্পের বাইরে বল ছাড়ছে। চার মারছে। এ বার গোটা প্রক্রিয়াটা সে নিজের মধ্যে ‘লক’ করে দেয়, পরের দিন যাতে প্রথম বল থেকে সেই লকের চাবি খুলে বাইশ গজে অনাবিল হতে পারে। শনিবার যেমন অত্যাশ্চর্য ভাবে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে উইকেটের পাশে পাওয়া গেল। সেই শ্যাডো করে যাচ্ছেন।
বোলাররাও একই ভাবে উইকেটের কাছে গিয়ে গুড লেংথ স্পট দেখে নেন। রান আপের জায়গাটা পরিষ্কার কি না, ছকে নেন। পিচে চোখ বোলান। কিন্তু সেটা ম্যাচের দিন সকালে। তাই শনিবার দুপুরে যখন সাদা টি-শার্টে দুই বোলারকে অবিরত এমসিজি উইকেটের পাশে শ্যাডো রান আপ আর ডেলিভারি করে যেতে দেখলাম, অবাক লাগল! প্রেসবক্স থেকে বোঝা যাচ্ছিল, তবু নীচে টিভির লোকেদের কাছে নিশ্চিত হলাম। হ্যাঁ, মর্নি মর্কেল ও ডেল স্টেইন। তারকা বোলারও ম্যাচের আগের দিন বাইশ গজে আগাম ‘ভিসুয়ালাইজ’ করছে— ইতিহাস সৃষ্টির মাঠ কি আর একটা ইতিহাসের খিড়কি-দরজা তৈরি করে দিয়ে গেল?
হয়তো এবং তার চেয়েও অনেক তাত্পর্যপূর্ণ যেটা, বিশ্বকাপ মহল রোববারের ম্যাচটাকে কী চোখে দেখছে? অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়ই বা কী ভাবে নিচ্ছে?
বাস্তবের চোখে নিয়মরক্ষার চেয়ে বাড়তি তাত্পর্যের নয়। এটা বিশ্বকাপ ফুটবল নয় যে, গ্রুপ পর্যায় থেকে অনন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। যেখানে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা কাসিয়াসকে প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল না খেলেই ব্রাজিল ইমিগ্রেশন ছেড়ে যেতে হচ্ছে! এটা নিস্তরঙ্গ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, যা ফর্ম্যাট অনুযায়ী প্রথম দু’ম্যাচে পর্যুদস্ত মিসবার পাকিস্তানকেও আশা হারাতে দেয় না। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী বি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন অর্থাত্ বি১ খেলবে এ৪-এর সঙ্গে। আর বি গ্রুপের রানার আপ বি২ খেলবে এ৩-এর সঙ্গে। এমসিজিতে ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকা যারাই হারুক, বি২-র নীচে নামবে এমন দুর্ভাবনা কাগজে-কলমে নেই। আর সেটা যদি না হয়, কোয়ার্টার ফাইনালে ও-দিকে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে খেলা পড়ার সম্ভাবনাও কম।
বাংলা কথা— জীবন-মরণ তো নয়ই, এমনকী বিশাল কোনও গুরুত্বেরও না। তবু মর্কেল-স্টেইনদের সমর্পিত প্রাণ, কোহলির হালকা উত্কণ্ঠা— এই সবই মর্যাদার ব্যাপারটা মাথায় রেখে। বাস্তব নিয়ে স্কোরার ভাবে। আইসিসি ভাববে। মিডিয়া ভাববে। কিন্তু তারকা প্লেয়ারদের তো নিজেদের কাছে ম্যাচ জিততে পারার একটা তাড়না আছে। একটা অহংবোধ আছে। তা ছাড়া বিশ্বসেরা টিম যারা হতে চায়, তারা নিয়ম আর তাত্ক্ষণিক বাস্তবতায় নিজেদের আবদ্ধ রাখবে কেন? সে তো খেলছে মহাকালে জায়গা পেতে!
দু’হাজার এগারোর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলকে প্রস্তুতি শিবিরের শুরুর দিকে বলেছিলেন কোচ— “ইতিহাস তৈরি করতে চাও, না ইতিহাসের অংশ হতে চাও?”
এই দক্ষিণ আফ্রিকান টিম সচিনদের চার বছর আগের মন্ত্র নিয়েছে। ভারত তা-ও সে বার গ্রুপ লিগে হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকারই কাছে। কিন্তু ২০১৫-র দক্ষিণ আফ্রিকান টিম দেড় মাস টানা ভাল খেলে অপরাজিত থাকতে চায়। জিততে চায় সব ম্যাচ। পরে তারা ভেবে দেখবে কোনটা ভারতের সঙ্গে গ্রুপ লিগ ছিল, কোনটা সেমিফাইনাল, কোনটা ফাইনাল!
ছিয়ানব্বই হাজার লোক বসতে পারে মেলবোর্ন মাঠে। এখনকার ইডেনের চেয়ে তিরিশ হাজার বেশি। নাটক সৃষ্টির ক্ষমতাও ঐতিহাসিক ভাবে ইডেনের চেয়ে বেশি। টেস্ট ইতিহাসের প্রথম জয় থেকে বিরানব্বই কাপ ফাইনালে আক্রমের রিভার্স সুইংয়ে ল্যাম্বের উইকেট। বক্সিং ডে টেস্টের শেষ বলে লিলির ভিভকে আউট করা থেকে অডি জিতে বর্তমান ভারতীয় টিম ডিরেক্টরের চক্কর। এই মাঠ কিছু না কিছু সব সময় দেখছে। যার বেশির ভাগটাই ‘এক্সএক্সএল’, নর্ম্যাল সাইজ নয়। শনিবার বিকেলে নামা বৃষ্টির মতো অভাবিত। বা মেলবোর্নের রাস্তায় ঝলমলে ‘হোয়াইট নাইট’ উত্সব ঘিরে গোটা ডাউনটাউন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো মায়াবী।
এসসিজি আরও সুন্দর। লর্ডস আরও অভিজাত। ইডেন আরও জীবন্ত। কিন্তু এমসিজি হল সাবেকি অ্যাম্ফিথিয়েটার। আমেরিকানদের কফির সাইজের মতো পুঁচকে হওয়ার উপায় নেই তার। সব কিছু হতে হবে ব্লকবাস্টার। মাঠের ছাপটাই যেন দীর্ঘকালীন। পাশে রড লেভার এরিনা। মধ্যিখানে একটা শুধু ব্রিজ পার করা। এত কাছে নয় যে, ধোনির ছক্কা গিয়ে টেনিস কোর্টে পড়তে পারে। আবার এত দূরেও নয় যে, অশ্বিন-জাডেজার ‘স্পিন পার্টনারশিপ ডটকম’ উইকেট পেলে তার চিত্কার দু’নম্বর কোর্ট অবধি পৌঁছবে না!
এবি ডে’ভিলিয়ার্স বলে দিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা অল পেস অ্যাটাক খেলাবে না। শন পোলক বললেন, “আমি একমত। ইমরান তাহির দারুণ বল করছে।” যা শুনে সৌরভ আবার বললেন পোলককে, “শন, ভারতের সামনে কিন্তু শেন ওয়ার্নও ছাদে পড়েছিল। ইমরান তাহির কোথায় পড়তে পারে ভেবে দেখেছ?” ফের বোঝা গেল, বাস্তবতার গণ্ডিতে ম্যাচটা মোটেও আবদ্ধ নেই।
মাঠের তলায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রীড়া জাদুঘর রয়েছে। এমসিজি-র সেই জাদুঘরে লিলির অ্যালুমিনিয়াম ব্যাট থেকে ট্রাম্পারের গ্লাভস। ম্যাকার্টনির ব্যাট থেকে গিলক্রিস্টের উইকেটকিপিং গ্লাভস। আর উনিশশো সাতাত্তরে শতবার্ষিকী টেস্টের সেই অবিস্মরণীয় ছবি, যেখানে বডিলাইনের দুই সংহারক লারউড-ভোস পাশাপাশি বসা। আর সংহার হওয়া ব্র্যাডম্যান অনেক দূরে অন্য কোণে দাঁড়ানো। ছবিটা আজও বলে দিচ্ছে, ঝগড়াটা চার দশক পরেও মেটেনি।
ক্রিকেট ইতিহাসের এমন ফার্স্ট বয়ের মাঠে বৃষ্টি সামান্যই ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। বাস্তবও তাই।
ইতিহাসের লম্বা লম্বা কেব্ল লাইন চারপাশে এমন ছড়ানো যে, প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমে তার নেটওয়ার্কের সিগন্যালই বেশি ধরতে বাধ্য। সে একটা টিমের অধিনায়ক যতই বাস্তব-আকৃষ্ট ও ইতিহাস-নিরুত্সাহ মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হোন না কেন!