ভারতের ঘাতক ও’কিফ। ৩৫ রানে ৬ উইকেট। ছবি: পিটিআই।
লং অফের উপর দিয়ে স্টিভ ও’কিফের বলটা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কে এল রাহুল। পারলেন না। ধরা পড়ে গেলেন বাউন্ডারির এ পারেই। ডেভিড ওয়ার্নারের হাতে।
তার পরই শুরু আউটের মহা মিছিল। এগারো রানে পরপর সাত উইকেট। শুক্রবার তিন ঘণ্টাও ক্রিজে দাঁড়াতে পারলেন না ভারতীয়রা! ১৭৩ মিনিটে শেষ তাদের ইনিংস। বোর্ডে ১০৫ রান। কে বলবে, ভারত স্পিনের স্বর্গ! নিজেরাই যে স্পিনের ফাঁদে বন্দি তারা। এ তো নিজেদের তৈরি ফাঁদে নিজেরাই আটক। ঘূর্ণি উইকেট বানিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে চাপে ফেলতে গিয়ে এখন নিজেরাই চাপে বিরাট কোহালির দল। দ্বিতীয় দিনের শেষেই প্রায় তিনশো রানে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। শনিবার তৃতীয় দিনে আরও একশো রান তুলে নিলে প্রথম টেস্টই হারতে হতে পারে কোহালিদের।
দ্বিতীয় দিনেই ঝুরঝুরে হয়ে ওঠা এই উইকেটে চারশো রান তাড়া করে জেতাটা যে বেশ কঠিন, প্রথম ইনিংসে তা বুঝেই নিল ভারত। তা হলে আর এমন উইকেট বানিয়ে লাভ কী হল? সুনীল গাওস্কর তো কমেন্ট্রি বক্সে বসে পরিষ্কার বলেই দিলেন, ‘‘চতুর্থ ইনিংসে এখানে সাড়ে তিনশো রান তাড়া করে জেতা বেশ কঠিন হবে।’’
আরও পড়ুন
‘অধিনায়ক বিরাটের আগ্রাসনের মধ্যে সৌরভের সেই আবেগ দেখতে পাই’
গাওস্করের মুখে যখন এই কথা, তখন কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বীরেন্দ্র সহবাগ। এক সতীর্থকে বললেন, ‘‘বলেছিলাম না, ল অব অ্যাভারেজে ভারত একটা ঝটকা খাবে? এই সেই ঝটকা।’’ ঝটকাটা বেশ জোরেই লাগল টিম ইন্ডিয়ার। সকালে বিরাট কোহালির খালি হাতে ফিরে যাওয়া দিয়ে যার শুরু। আর এগারো রানের মধ্যে দলের সাত উইকেট পড়া দিয়ে যার শেষ।
তাসের ঘর: ১১ রানে গেল ৭ উইকেট
• ৩২.২ ওভার: রাহুল আউট। ও’কিফের বলে লং অফের উপরে মারতে গিয়ে ওয়ার্নারকে ক্যাচ দিলেন।
• ৩২.৪ ওভার: রাহানে আউট। ও’কিফের বলে লেগ সাইডে মারতে গিয়ে উল্টে দ্বিতীয় স্লিপে হ্যান্ডসকোম্বকে ক্যাচ তোলেন।
• ৩২.৬ ওভার: ঋদ্ধিমান আউট। দুর্দান্ত লেংথে বলটা রাখেন ও’কিফ। ঋদ্ধির গ্লাভসে লেগে সোজা বলটা যায় স্লিপে থাকা স্মিথের হাতে।
• ৩৩.৩ ওভার: অশ্বিন আউট। লায়নের বলে ডিফেন্সিভ স্ট্রোক খেলতে গিয়ে বলটা তাঁর ব্যাটে লেগে পায়ে লেগে সোজা হ্যান্ডসকম্বের হাতে।
• ৩৬.৩ ওভার: জয়ন্ত যাদব আউট। ও’কিফের স্পিনে খুব বেশি স্ট্রেচ করে শট মারতে গিয়ে ব্যাটেই লাগাতে পারেননি। সহজ স্টাম্পিং।
• ৩৮.২ ওভার: জাডেজা আউট। ধৈর্য ধরে খেলার বদলে অহেতুক বড় শট মারতে গেলেন। ও’কিফের বলে স্টার্কের হাতে ক্যাচ দিলেন।
• ৪০.১ ওভার: উমেশ আউট। স্টেপ আউট করে মারতে যান। ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে স্মিথের হাতে ক্যাচ।
আত্মতুষ্টির কুফল? না অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পিত প্রস্তুতির সুফল?
না হলে এ ভাবে কোনও এক স্টিভ ও’কিফের ফাঁদে বন্দি হয়ে যায় বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দলের ব্যাটিং লাইন-আপ? ঘূর্ণি উইকেটে খেলার মতো ভাল ব্যাটসম্যানই যখন নেই দলে, তখন এমন পিচ বানানোর যুক্তিটা কোথায়?
প্রশ্নটা এখানকার কিউরেটর পান্ডুরঙ্গ সালগাওকরকে করতেই তাঁর প্রায় ফেটে পড়ার উপক্রম। বললেন, ‘‘আপনারাই লিখুন। বাঁকা পথে গিয়ে কখনও সাফল্য পাওয়া যায় না। যে উইকেট বানানো ছিল, সেই উইকেটে ভারত এ ভাবে শুয়ে পড়ত না। বড় রানের একটা ইনিংস গড়ত। এখন দেখুন কী অবস্থা। নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ে বসে থাকলাম আমরা।’’
এখানেই শেষ নয়। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে চার-চারবার জীবন পেয়েছে। স্টিভ স্মিথেরই ক্যাচ পড়েছে তিন বার। একাধিক লাইফলাইন পেয়ে সেই তিনিই দিনের শেষে ৫৯ রানে অপরাজিত। ১৩ বছর আগের সেই ব্যাটিং ধসে যিনি ছিলেন, সেই মহম্মদ কাইফকে এ দিন ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘‘এতগুলো ক্যাচ মিস করলে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিরুদ্ধে যে টেস্ট জেতা যায় না, সেটা আর কবে বুঝবে আমাদের ক্রিকেটাররা?’’ আর ব্যাটিং ধস নিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘বোধহয় অস্ট্রেলিয়াকে হাল্কা করে নেওয়ার ফল। অস্ট্রেলিয়ার আচমকা ধাক্কায় আমাদের ব্যাটসম্যানরা চমকে গিয়েছে।’’
মুম্বইয়ে ২০০৪-এর সেই ম্যাচেও এমনই হয়েছিল বলে জানান কাইফ। বলেন, ‘‘সে বার ম্যাকগ্রা আর গিলেসপির সেই ধাক্কা আমরা কেউ সামলাতে পারিনি। আজ তো স্টিভ ও’কিফ একাই শেষ করে দিল।’’ ও’কিফের একারই হাফ ডজন শিকার। মিচেল স্টার্ক নিলেন দুই উইকেট।
মন্টি পানেসরকে ডেকে ও’কিফ-কে ভারত সফরের জন্য তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ২০১২-র মুম্বই টেস্টে ইংল্যান্ডের জয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন মন্টি। প্রথম ইনিংসে পাঁচ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ছ’উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ড সেই টেস্টে ভারতকে হারিয়েছিল ১০ উইকেটে। সেই সফরে তিন টেস্টে ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন বাঁ হাতি স্পিনার মন্টি। সেই মন্টিকে ও’কিফের পিছনে প্রায় সপ্তাহ খানেক লাগিয়ে রাখা হয়েছিল ভারতে কী করে ভাল বল করবেন, তার তালিম দিতে।
দুবাইয়ে প্রস্তুতি শিবির থেকে মন্টির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে ও’কিফ তাঁর চূড়ান্ত প্রস্তুতি সারেন। ও’কিফ বললেন, ‘‘মন্টির কাছ থেকে শুধু টেকনিক নয়, আত্মবিশ্বাসটাও পেয়েছি। এখানে সফল হতে অন্য রকমের মানসিকতা লাগে, বুঝিয়েছিল আমায়। আর একজনের কথা অবশ্যই বলব, শ্রীধরন শ্রীরাম। আমাদের স্পিন কোচ। ভারতের কন্ডিশন বুঝে ভাল বোলিংয়ের পাঠটা ওর কাছ থেকেই নেওয়া।’’
লাঞ্চের আগে মিচেল স্টার্কের অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে বিরাট যে ভাবে ফিরে গেলেন, তা যেমন অবাক করার মতো, তেমনই উইকেটে একেবারে সেট হয়ে যাওয়ার পরও অনর্থক চালাতে গিয়ে রাহুলের আউট হওয়াটাও কম বিস্ময়ের নয়।
স্টার্কের অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা যেন চুম্বকের মতো কোহালির ব্যাটটাকে টেনে নিল। সহবাগ টিভিতে বললেন, ‘‘মনে হয় লোভের বশে এটা করে ফেলেছে বিরাট। শুরুতেই রানের লোভ হয় ব্যাটসম্যানদের।’’ কিন্তু তাঁর কোচ রাজকুমার শর্মা তা মানতে রাজি নন। বললেন, ‘‘বিরাট নিশ্চিত না হয়ে কোনও শট খেলে না। ও নিশ্চয়ই শিওর ছিল। ওর থাকবে রানের লোভ? মাফ করবেন, মানতে পারলাম না।’’
চারটে টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি থাকা ব্যাটসম্যানের সঙ্গে যদিও তত্ত্বটা যায় না। কিন্তু বিরাট এক দিন ব্যর্থ হলে কি বাকিদেরও তাঁকে এ ভাবেই অন্ধ অনুসরণ করতে হবে?
এ কেমন আনুগত্য?