রিও থেকে সিন্ধু ফিরলে ওকে কী উপহার দেব ভাবতে ভাবতে বুধবার ভোরে ঘুমোতে গেলাম।
সবে চিকুনগুনিয়ার ধাক্কা সামলে উঠেছি। ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও রাত জেগে ম্যাচটা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। ধন্যবাদ পিভি (এই নামেই সিন্ধুকে আমরা ডাকি)। আমার শরীর যতই দুর্বল থাক, মনটাকে আনন্দে ভরিয়ে তোলার জন্য। ইহানকে হারিয়ে সিন্ধু অলিম্পিক্স সেমিফাইনালে ওঠার পরে ওর মোবাইলের ভয়েস মেলে আমার মেসেজটাও ঠিক এটাই রেখেছি।
তবে এর পরেও সিন্ধু ফাইনালে উঠে রিওতে ভারতের প্রথম পদক নিশ্চিত করবে, সেটা কিন্তু সাহসের সঙ্গে এই লেখায় বলতে পারছি না।
প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, এখনও বিশ্বের দু’নম্বর ইহানের টেকনিকের সঙ্গে সাইনা যতটা এঁটে উঠতে পারে না, আমার মতে সিন্ধু ঠিক ততটাই পারে। ইহানের বিরুদ্ধে সিন্ধুর ৩-৪ হেড-টু-হেডের পাশে সাইনার ৫-১১ হিসেবেই সেটা পরিষ্কার। ইহানের লম্বা র্যালির পাল্টা জবাব সিন্ধু-সাইনা দু’জনই দেয়। কিন্তু সিন্ধু যেখানটায় এগিয়ে তা হল, ইহানের স্ম্যাশ-হাফস্ম্যাশের কাউন্টার সমানে-সমানে করে। ইহানের অ্যাটাকের সামনে সাইনার মতো গুটিয়ে যায় না সিন্ধু। ওর পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি হাইটকে কাজে লাগিয়ে ইহানের স্ম্যাশকে নেটের অনেকটা উঁচুতে রিসিভ করে ফেলতে পারে। আর কাউন্টার স্ম্যাশও অত উঁচু থেকে মারায় সেটা আরও মারাত্মক হয়। তা ছাড়া সাইনার খেলাটা যেমন ডিফেন্সিভ র্যালি নির্ভর, সিন্ধু সেখানে বরাবরের অ্যাটাকিং প্লেয়ার। তার উপর ওর আগের চেয়ে পায়ের জোর অনেক বাড়ায় এখন কোট কভারিংও ভাল করতে পারছে।
তবে ব্যাডমিন্টনে সিন্ধুর মতো খুব লম্বা প্লেয়ারদের মধ্যে ক্ষিপ্রতার একটা স্বাভাবিক কমজোরি থাকে। আসলে শাটল গেমে প্লেয়ারকে ম্যাচের প্রায় সত্তর ভাগ রিটার্ন শরীর ঝুঁকিয়ে মারতে হয়। খুব লম্বা প্লেয়ারের পক্ষে তাই বলে বলে নিচু হওয়া খুব কঠিন। সে তোমার ফিটনেস লেভেল যতই ভাল হোক না কেন! ইহানের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে সিন্ধুকে অবশ্য আগের চেয়ে বেশি ফিট আর স্ট্যামিনাও বেশি লাগল আমার। কিন্তু সেটা দিয়েও সেমিফাইনালে ওকুহারার মতো দুর্ধর্ষ ফর্মে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বীর চ্যালেঞ্জ সিন্ধু কতটা সামলাতে পারবে বলতে পারছি না।
ইহান বয়সে সাত বছরের সিনিয়র হলেও ওকুহারা সিন্ধুরই বয়সি। কুড়ি পেরিয়েছে সবে। সুতরাং দমে কারও অন্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকার কথা নয়। ওকুহারা বেঁটে (পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি) বলেও সিন্ধুর কোনও সুবিধে হবে বলে আমি মনে করি না। বরং শাটল গেমের চরিত্র অনুযায়ী ওকুহারাকে কাল কোর্টে বেশি ক্ষিপ্র দেখার সম্ভাবনা। রিওতে সিন্ধু দারুণ ফর্মে আছে ঠিক কথা। তবে গত এক বছরে মেয়েদের ব্যাডমিন্টনে বিশ্বে সবচেয়ে উন্নতি যদি কোনও প্লেয়ার করে থাকে তার নাম ওকুহারা। অবিশ্বাস্য ওর রিফ্লেক্স। বিশেষ করে নেটের সামনে। এ বছরই অল ইংল্যান্ডে সেমিফাইনাল-ফাইনালে পরপর বিশ্বের এক নম্বর ক্যারোলিনা মারিন আর গত অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন লি জুয়েরুইকে হারিয়ে ট্রফি জেতা যার জ্বলন্ত প্রমাণ। ব্যাডমিন্টনের পেশাদার সার্কিটে সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট সুপার সিরিজ মাস্টার্স ফাইনালসও গত বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ওকুহারা। সিন্ধু ওকে জুনিয়র সার্কিটে এক বার হারালেও সিনিয়র লেভেলে তিন বার খেলে এখনও জিততে পারেনি। শেষ হারটা এ বছরই হায়দরাবাদে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে।
তবে অলিম্পিক্স অন্য সব টুর্নামেন্টের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। সিন্ধু-ওকুহারা দু’জনেরই জীবনের প্রথম অলিম্পিক্স কাকে বিশেষ দিনে বেশি তাতিয়ে তুলবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তা ছাড়া রিওতে সিন্ধুর মধ্যে দারুণ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি। আগে ওর ম্যাচ তৃতীয় গেমে গড়ালে ওকে একটু ক্লান্ত দেখাতে শুরু করত। এ বার সেটা উধাও। এটা হয়েছে বাড়তি ফিটনেস আর স্ট্যামিনার জোরে। আর কোর্টে ঠান্ডা মাথা আর ধৈর্য তো সিন্ধুর বরাবরের গুণ। সেই দু’হাজার এগারো থেকে ট্রেনিংয়ে ওকে ঘাঁটছি তো! তাই আরও ভাল জানি।
ওকুহারার সঙ্গে অলরাউন্ড স্কিলে না হোক, ওই চারটে ‘স্ট্রোক’-এ ম্যাচ বার করে নিতে পারে আমাদের মেয়ে। তা হলেই পদক!