জার্মান ফুটবলের আবেগপ্রবণ চরিত্র হিসেবে বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগারের অল্প-বিস্তর নামডাক আছে। বছর চারেক আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখ জার্সিতে টাইব্রেকারে পেনাল্টি নষ্টের পর জার্সিতে মুখ গুঁজে তাঁর অঝোর কান্নার দৃশ্য তো আজও ভুলতে পারেনি কেউ। রিও দে জেনেইরোয় কাপ তোলার পর শিশুর উচ্ছ্বাসে জার্মান অধিনায়কের গোটা মারাকানা দৌড়ে বেড়ানোও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়নি। কিন্তু তার পরেও ইউরো থেকে বিদায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমর্থকদের খোলা চিঠি লিখে বসবেন সোয়াইনস্টাইগার, অভাবনীয়।
সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ক্ষমাপ্রার্থী সোয়াইনস্টাইগার লিখে দিয়েছেন, তাঁর লজ্জা হচ্ছে। লজ্জা হচ্ছে, রিও-র পরে আরও একটা স্বপ্নের রাত মানশাফটকে দিতে ব্যর্থ হওয়ায়। জার্মান অধিনায়ক কাতরোক্তি করেছেন যে, আর কিছু নয়, বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের স্তাদ ভেলোদ্রোমে একটু ভাগ্যের দরকার ছিল। জয়-পরাজয় খেলায় থাকে, বাস্তিয়ান জানেন। কিন্তু কোনও কোনও হার ভেতরটাকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। ফ্রান্সের থেকে বাস্তিয়ান কিছু কেড়ে নিতে চান না। ফ্রান্সকে ইউরো ফাইনালে ওঠার যাবতীয় কৃতিত্ব তিনি দিতে রাজি। কিন্তু এই যন্ত্রণা তাঁর অসহ্য মনে হচ্ছে।
অতীব মর্মস্পর্শী চিঠি। কিন্তু জার্মানি তাতে প্রভাবিত হবে তো? বৃহস্পতিবার রাতে জার্মান সমর্থকদের দেখার পর মনে হয়, না। অপার নিস্তব্ধতার মর্মর মূর্তির মতো এক-একজন দাঁড়িয়ে। টিম হেরে গেলে কান্নাকাটি করা ধাতে নেই জার্মান জাতটার। দেশের পতাকার রঙে যে মালাগুলো তাঁরা পরে আসতেন এত দিন, সেগুলো নিঃশব্দে খুলে ফেলতে দেখা গেল। হয়তো বা বাস্তিয়ানের প্রতি শ্রদ্ধার মালাটাও অজান্তে খুলে ফেললেন ওঁরা। গর্বের অধিনায়কের আজ থেকে ধিক্কার প্রাপ্য।
জার্মান মিডিয়া তুলোধোনা করে ছেড়ে দিয়েছে সোয়াইনস্টাইগার এবং কোচ জোয়াকিম লো-কে। টিমের অধিনায়ক তিনি, আর তিনিই কি না পেনাল্টি বক্সে উড়ে আসা ক্রসে হাত ছুঁইয়ে দিলেন! বিরতির মিনিটখানেক আগে ওই ‘দুর্ঘটনায়’ এতটাই আক্রান্ত হয়ে পড়ে ইস্পাত-কঠিন জার্মান মানসিকতা যে, ড্রেসিংরুমে ফিরেও ইয়োগি টিমকে শান্ত করতে পারেননি। টিম দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমে চেনা জাত্যভিমান দেখাতে তো পারেইনি, উল্টে অন্তর্কলহে জড়িয়ে পড়েছে।
টনি ক্রুজ নাম না করে আক্রমণ করেছেন অধিনায়ককে। “পেনাল্টি বক্সে বলে ও ভাবে হাত ছোঁয়ানো বোকার মতো কাজ,” বলেছেন ক্রুজ। পরোক্ষে যেন বলে দেওয়া— ক্যাপ্টেন, তোমার বালখিল্যপনাতেই আমরা আজ ডুবলাম!
ফ্রান্সে এত দিন ধরে পড়ে থাকা জার্মান সমর্থকদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে, এটা বোধহয় ভবিতব্যই ছিল। এঁরা বারবার বলছিলেন, জার্মানির সেই ভয়াল মেজাজ কিছুতেই খেলায় খুঁজে পাচ্ছেন না। যে কোনও দিন ছুটি ঘোষণা হয়ে যাবে। গোটা কয়েক কারণও পাওয়া যায় এমন বিপর্যয়ের। এক) মুলারের অভিশাপ। দুটো ইউরো মিলিয়ে একটাও গোল নেই। দুই) বুড়োদের টিম। বাস্তিয়ান-হাওয়েদেসের মতো কেউ কেউ তিরিশের উপরে চলে গিয়েছেন। তিন) ডাইরেক্ট ফুটবল ভুলে লো-র তিকিতাকা স্টাইল ব্যর্থ। চার) মিরোস্লাভ ক্লোজের যোগ্য বিকল্প দু’বছরেও খুঁজে বার করতে পারেনি ডিবিএফ। পাঁচ) দুর্বল রিজার্ভ বেঞ্চ।
জার্মান কোচ তার মধ্যে আবার নতুন অগ্নিসংযোগ করে গিয়েছেন। সেমিফাইনাল হেরে যাওয়ার পরেও লো বলেছেন, “খেলল জার্মানি, জিতল ফ্রান্স। আমি প্লেয়ারদের নিয়ে গর্বিত।” যা শুনে ভয়ঙ্কর চটেছে জার্মান মিডিয়া। বলাবলি চলছে, এত উর্ধ্ববাহু প্রশংসার কী মানে? তোমার টিম দু’টো ম্যাচে পরপর হ্যান্ডবলে প্রতিপক্ষকে পেনাল্টি উপহার দেয়। লক্ষ সুযোগ সৃষ্টি করেও গোল করতে পারে না। তাদের এত আগলে রাখার কী আছে? আর তুমি আসল কাজটার দিকেই মন দিতে পারোনি। মারিও গোমেজের বিকল্প হিসেবে কাউকে বার করতে পারোনি।
উষ্মার কারণ বোঝা যায়। লো-র হাত ধরেই বিশ্ব-ফুটবলের মঞ্চে উত্থান জার্মানির। য়ুরগেন ক্লিন্সম্যান বারো বছর আগে এক ইউরো বিপর্যয়ের পর যে ধুলোকালি মাখা রাজপ্রাসাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেখানেও সহকারী হিসেবে ছিলেন লো। ক্লিন্সম্যান ছেড়ে যাওয়ার পর প্রাসাদের মালিকানা একচ্ছত্র নেন। তার পর দেশকে পরপর ইউরো ফাইনাল আর সেমিফাইনালে তুলেছেন, এক বার বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তার পর আবার ইউরো সেমিফাইনাল। পারফরম্যান্স হিসেবে খারাপ নয় মোটেই, কিন্তু বিশ্বজয়ের স্বর্ণ-ঝলসানির পাশে যে বড় চোখে লাগে।
তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়েও জল্পনা চলছে। রাশিয়া বিশ্বকাপ পর্যন্ত তাঁর চুক্তি আছে জেনেও মিডিয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি জার্মানির পরের ম্যাচে সাইডলাইনে থাকছেন তো? লো বলে দিয়েছেন, “হুম, মনে তো হয়।” অচেনা গন্ধ পেয়ে ডিবিএফ প্রেসিডেন্ট রেনার্দ গ্রিন্ডেলকে ধরেছে মিডিয়া। তিনি বলে দিয়েছেন, “হ্যাঁ, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কোচ। চুক্তিও আছে।”
দুর্ভাগ্য লো-র, জার্মান ফুটবল প্রেসিডেন্টের গলাটাও তাঁর মতো জোরালো শোনায়নি!