হতাশা: দ্রুত রান তুলতে ব্যর্থ দীনেশ কার্তিক। মঙ্গলবার। এপি
আমার স্মৃতি যদি খুব একটা বিশ্বাসঘাতকতা না করে, ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ খেলতে গিয়েছিল অজিত ওয়াড়েকরের ভারত। সেই সফরে তিনজন উইকেটকিপার ছিল ভারতীয় দলে। ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, সৈয়দ কিরমানি ও কৃষ্ণমূর্তি। যদিও তিনজনকে প্রথম একাদশে খেলানো হয়নি কখনওই।
মঙ্গলবার এজবাস্টনে দেখা গেল সাড়ে তিনজন কিপার নিয়ে নামল ভারত। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, ঋষভ পন্থ, দীনেশ কার্তিক ও অর্ধেক কিপার কে এল রাহুল। এত কিপার নিয়ে ভারত আগে কখনও নেমেছে কিনা আমার স্মরণে পড়ছে না। তাতে ভারতীয় দলের কী লাভ হল?
লাভ একটিই, ঋষভ পন্থ। ৪১ বলে ওর ৪৮ রানের ইনিংস ব্যাটিং অর্ডারের চার নম্বরের চিন্তা অনেকটা মিটিয়ে দিল। মুম্বইয়ের স্থানীয় ক্রিকেটে কোনও ব্যাটসম্যান ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেললে তাকে বলা হয় ‘খারুস ক্রিকেটার’। যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় রোহিত শর্মার মধ্যে। ঋষভ দিল্লির ছেলে হলেও ওকে ব্যাখ্যা করা যায় ‘খারুস’ হিসেবে।
ঋষভ নামার সময় দলের স্কোর ১৯৫-২। ইনিংসের বয়স ৩২.৪। শুরু থেকেই আগ্রাসী মেজাজে খেলতে দেখা গেল ২১ বছর বয়সি ব্যাটসম্যানকে। ষষ্ঠ বলেই মোসাদ্দেক হুসেনকে স্টেপ আউট করে যে সোজা ছয় মারল, তাতেই বোঝা গেল বিন্দুমাত্র স্নায়ুর চাপ ওর মধ্যে নেই।
সাহসিকতার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ওর ইনিংসে। ৩৯তম ওভারে বিরাট কোহালি ও হার্দিক পাণ্ড্য ফিরে যায়। পরের ওভারেই মোসাদ্দেক হুসেনকে তিনটি চার মেরে দলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনল পন্থ। তার মধ্যে একটি শট কপিবুক কভার ড্রাইভ। একটি শটেই বোঝা গেল ওর দক্ষতা কতটা। স্পিনারকে ভাল খেলতে হলে, স্টেপ আউট করা জরুরি। বল পড়ার সঙ্গেই মারো। ঘোরার সময় দিও না। সুনীল গাওস্কর, মাইকেল ক্লার্কের এত ভাল স্পিন খেলার কারণ অবশ্যই তাদের পায়ের ব্যবহারের জন্য। ঋষভের মধ্যেও ভাল স্পিন সামলানোর ইঙ্গিত
পাওয়া গেল।
ঋষভের ইনিংস বুঝিয়ে দিল, ব্যাটিং কতটা পাল্টে গিয়েছে। আমাদের কোচেরা বলতেন, দ্রুত উইকেট পড়ে গেলে শুরুর দিকে ইনিংস ধরতে হয়। ঋষভের মধ্যে ধরে খেলার কোনও পরিকল্পনা দেখা যায়নি। শুরু থেকেই আক্রমণ করে গিয়েছে। ওর জন্যই ৩০০ রানের গণ্ডি সহজে পেরোল ভারত। বিশ্বকাপের প্রথম হাফসেঞ্চুরি পাওয়া উচিত ছিল। শাকিব আল হাসান ১০ ওভারে মাত্র ৪১ রান দিয়েছে। কিন্তু ঋষভের বিরুদ্ধে রান আটকাতে ব্যর্থ। ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে যে ফিল্ডার শাকিব রেখেছিল, তার পাশ দিয়ে ও মাথার উপর দিয়েও সুইপ মেরে রান কুড়িয়ে নিচ্ছিল পন্থ। আউটও হল সুইপ করতে গিয়ে।
এ বার আশা যাক দীনেশ কার্তিকের ইনিংসে। তাকে কেন খেলানো হল, বোঝা যায়নি। আমার দলে কার্তিকের পরিবর্তে জায়গা করে নেবে রবীন্দ্র জাডেজা। প্রত্যেক বিভাগেই সম্পূর্ণ। ফিল্ডিংয়ে অন্তত ২০ রান বাঁচিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ব্যাটিংয়ে দ্রুত রান করতে পারে। ওয়ান ডে-র আদর্শ বোলিংও ওর থেকে আশা করা যায়। এ দিন কার্তিক যে জায়গায় নেমেছিল, সেখানে ১৫ বলে ৩৫ রানের একটি ইনিংস প্রয়োজন ছিল। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য কার্তিক আদর্শ ব্যাটসম্যান নয়। মুস্তাফিজ়ুর রহমানের স্লোয়ার বাউন্সারে যে ভঙ্গিতে আউট হয়েছে তা দৃষ্টিকটূ। একেবারে টেনিসের মতো স্ম্যাশ করতে গিয়ে মিসটাইম করল। ওর জন্য অন্তত ২০টি রান কম হয়েছে। আশা করব শনিবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কার্তিকের পরিবর্তে দলে রাখা হোক জাডেজাকে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে ওর সেরা সময় যাচ্ছে না। ক্রমাগত গ্রাফ নামছে। ২০১১ সালের ধোনির সঙ্গে ২০১৯-এর ধোনির মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য। যে দু’টি শটে ও সব চেয়ে বেশি রান পেত তা আর মারতে দেখা যাচ্ছে না। হেলিকপ্টার শট ও আপার স্কোয়ার কাট আর ওকে মারতে দেখি না। ধোনিকে আরও বিপদে ফেলে দিচ্ছে শুরুতে স্পিনারকে বল করিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দেখেছি ফাবিয়ান অ্যালেন ওকে আটকে রেখেছিল। এ দিনও শাকিবের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেনি। শেষ ওভারে দেখা গেল রান না নিয়ে ভুবনেশ্বকে ফিরিয়ে দিল। এখন আর ওর মধ্যে আগের সেই দাপুটে ফিনিশার হয়ে ওঠার ক্ষমতাটা নেই। যে টানা দু’টি বল বাইরে পাঠিয়ে দেবে। মুস্তাফিজ়ুরের সেই স্লোয়ার বাউন্সারই পরাস্ত করল ধোনিকে। টেকনিকের দিক থেকে ধোনি কখনওই খুব একটা শক্তিশালী নয়। দৃষ্টিশক্তি, পাওয়ার ও ভয়ডরহীন মানসিকতার জন্য রান করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। নিজের একটা স্টাইল রয়েছে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি ও জোর যখন কমে যায় তখনই তোমাকে বাঁচায় টেকনিক। সচিন তেন্ডুলকর, রিকি পন্টিংদের কিন্তু বয়স হলেও খেলতে অসুবিধা হয়নি। কারণ, টেকনিক একশো শতাংশ ঠিক ছিল। ধোনির সেখানে সমস্যা হচ্ছে। কিপিংয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সামনে বল পড়লে আর হাত বাড়ায় না। পা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। মহম্মদ শামির একটি বাউন্সার ধোনির হাতে লেগে বাই হয়ে গেল। ২০১১ সালের ধোনি কিন্তু এই বল ফস্কাতো না।
এ বার আসা যাক অর্ধেক কিপারের বিষয়ে। কে এল রাহুল শুরুটা ভালই করছে। কিন্তু হাফসেঞ্চুরির ইনিংস সেঞ্চুরিতে পরিণত করতে পারছে না। অনেক বলও নষ্ট করছে। এ দিনও ৭৭ রান করল ৯২ বলে। রাহুলকে শুরুতে একটু আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে হবে। তাতে পরের দিকের ব্যাটসম্যানদের উপর থেকে চাপ কমে যাবে।