স্বপ্নপূরণ: ওভালে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জেতার উৎসব। মর্গ্যানের হাতে কাপ ছুঁয়ে দেখছে খুদে ভক্তেরা। গেটি ইমেজেস
লর্ডস থেকে সড়কপথে যেতে লাগে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে জায়গাটার নাম কামব্রিয়া। যেখানে জনবসতি এখনও খুব ভাল করে গড়ে ওঠেনি। আয়তনের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম কাউন্টি হলেও জনসংখ্যার বিচারে অনেক পিছনে। কামব্রিয়ার নিজস্ব কোনও কাউন্টি টিম নেই। খুব কাছের দু’টি কাউন্টি যারা ক্রিকেটে পরিচিত নাম, তারা হল ডারহাম এবং ল্যাঙ্কাশায়ার। এক দিকে স্কটিশ সীমান্ত, অন্য দিকে আইরিশ সমুদ্র।
এমনই এক প্রত্যন্ত জায়গার একটি ক্রিকেট ক্লাব ককারমাউথ সিসি। ২০০৯ সালে বন্যায় ভেসে গিয়েছিল যাদের অস্তিত্বই। ওই ক্লাব থেকে উঠে আসা এক ক্রিকেটারের উদ্যোগ আর অর্থসাহায্যে বিপর্যয় কাটিয়ে ফের উঠে দাঁড়িয়েছে তারা। রবিবার লর্ডসে যখন ফাইনাল হচ্ছিল, সেই ক্লাবে জায়ান্ট স্ক্রিন লাগিয়ে খেলা দেখতে বসেছিলেন সকলে। কারণ, তাঁদের ক্লাব থেকে উঠে আসা সেই ছাত্র শুধু যে খেলছিলেনই না, গোটা দেশের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং, শেষ পর্যন্ত তিনিই হয়ে উঠলেন ফাইনালের নায়ক। যখন রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ শেষ হল পরপর দু’টো টাই দিয়ে এবং ঘোষণা করা হল, বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য ইংল্যান্ড বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, লর্ডসের মতোই গর্জনে ফেটে পড়েছিল ককারমাউথ ক্রিকেট ক্লাব। লর্ডসের মতোই বহু দূরের সেই ক্লাবে স্লোগান উঠছিল, ‘স্টোকসি, স্টোকসি’!
হ্যাঁ, লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়ের নায়ক বেন স্টোকসের চমকপ্রদ কাহিনির কথাই বলা হচ্ছে। ককারমাউথ ক্লাবের সেক্রেটারি জেফ মিনশ-কে অনেক চেষ্টার পরে ফোনে পাওয়া গেল সোমবার ইংল্যান্ডের সময় দুপুরের দিকে। প্রথমেই বললেন, ‘‘এখানে যে কী রকম উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে, বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের সকলের কাছে জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় দিন। বেন স্টোকসের জন্য গর্বিত গোটা ক্লাব।’’ গলায় তখনও যেন লর্ডসের শেষ বল হওয়ার উত্তেজনা। জেফ বলে চলেন, ‘‘ক্লাবে কাল জায়ান্ট স্ক্রিনে কত লোক খেলা দেখেছে, হিসেব নেই। আমরা দারুণ আয়োজন করেছিলাম। খাদ্য, পানীয়— সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল। তবে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল আমাদের ক্লাবের তরুণ ক্রিকেটারদের। ওদের কাছে বেন ছিল নায়ক। রবিবারের ফাইনালের পরে আরওই বড় রোল মডেল।’’
জেফ শোনালেন ক্রিকেটার হিসেবে বেন স্টোকসের বেড়ে ওঠার কাহিনি। বারো বছর বয়সে তাঁকে এই ক্লাবে ভর্তির জন্য নিয়ে আসেন বাবা জেরার্ড। ঠিক তার আগেই স্টোকস পরিবার নিউজ়িল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে এসে উঠেছে কামব্রিয়ায়। বাবা রাগবি দলের হেড কোচ ছিলেন। রবিবার লর্ডসে যখন ছেলে নিউজ়িল্যান্ডকে হারাচ্ছে, বাবা ও মা তখন ক্রাইস্টচার্চে। স্টোকসের পেশিবহুল হাত ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তা মাউরি ট্যাটুতে ভর্তি।
নায়ক: ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতানোর পরে এখন আকর্ষণের কেন্দ্রে বেন স্টোকস। সোমবার ওভালে নিজস্বী তুলছেন ভক্তদের সঙ্গে। গেটি ইমেজেস
ছেলের ক্রিকেট-প্রতিভা হাঁটতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়েছিল জেরার্ডের চোখে। ন্যাপি পরা বেন স্টোকস প্লাস্টিক ব্যাট হাতে যা মারতেন, সব স্ট্রেট ড্রাইভ। হল ঘরের করিডরে ছেলেকে ব্যাটিং করাতেন জেরার্ড। একটা বলও দেওয়ালে লাগত না। সেই দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছেলেকে ক্রিকেট কোচিংয়ে পাঠাবেন। অতঃপর কামব্রিয়ায় আগমন এবং ককারমাউথ ক্লাবে ভর্তি হওয়া। জেফ মনে করতে পারছেন, ‘‘বারো বছরের একটা কিশোরকে দেখে সত্যিই বোঝার উপায় ছিল না, এক দিন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলবে। বিশ্বকাপ জেতাবে। সেটা বললে মিথ্যাই বলা হবে।’’ দ্রুত এর পরে যোগ করলেন, ‘‘তবে এটা বলব যে, দু’টো জিনিস দেখে সকলে সোজা হয়ে বসেছিল। এক, ওর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা। সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, সেটা ওই ছোট বয়সেই পরিষ্কার ছিল। দুই, ব্যাটিংয়ের সময় ওর শক্তি আর টাইমিং। অত ছোট বয়সের কারও শটে অত জোর আমরা দেখিনি।’’
মানে কিশোর বয়স থেকেই বিগ বেন হয়ে ওঠার লক্ষণ ছিল? জেফের জবাব, ‘‘আমাদের ক্লাবে যখন এসেছিল, ওর বয়সের (১২) পক্ষে বেশ বড়সড় ছিল বেন। ভাল লম্বা ছিল, তখনই বেশ চওড়া কাঁধ। তবে খুব বিশাল শরীর ছিল, বলা যাবে না। সেটা পরে জিমে সময় দিয়ে, ট্রেনিংয়ে পরিশ্রম করে বানিয়েছে। কিন্তু অমানুষিক শক্তির ইঙ্গিত শুরু থেকেই পেতে শুরু করেছিলাম আমরা।’’ কিশোর স্টোকস এত দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করেন যে, তাঁকে উচ্চতর বয়সের বিভাগে খেলাতে শুরু করেন জেফরা। ‘‘ক্লাবে আসার দু’বছরের মধ্যে ও সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক ঘটায়,’’ বলছিলেন তিনি। জানালেন, তাঁদের ক্লাবের সেরা ছবি হয়ে আছে ২০০৬ সালের একটি গ্রুপ ফোটো। সিনিয়র ক্রিকেটে উত্তর ল্যাঙ্কাশায়ার এবং কামব্রিয়া লিগ জিতল ককারমাউথ। সব সিনিয়র ছেলের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে পনেরো বছরের কিশোর বেন স্টোকসের মুখ। ‘‘ওর ব্যাটিং তখন বোলিংয়ের তুলনায় বেশি নজর কাড়ছিল। কিন্তু ওর মধ্যে যে সহজাত অলরাউন্ড দক্ষতা রয়েছে, সেটাও খুব দ্রুত আমরা বুঝতে পারলাম,’’ বলে জেফ আর একটি কাহিনি শোনালেন, ‘‘কঠিন এক প্রতিপক্ষের সঙ্গে ১৩০ রানে অলআউট হয়ে যায় আমাদের টিম। বোলিং করার সময় কিছু হচ্ছিল না। বুঝতেই পারছিলাম, খুব সহজেই রানটা তুলে দেবে ওরা। একেবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বল তুলে দেওয়া হল বেনের হাতে। সেই ম্যাচে ১৫ রানে ছয় উইকেট নিয়ে আমাদের অবিশ্বাস্য ভাবে জিতিয়ে দিয়েছিল বেন।’’ এর পরে হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘‘আমরা তো ভেবেছিলাম, সুপার ওভারে বলটাও করবে বেন।’’
ককারমাউথের এক কিশোরের ক্রিকেট প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। ডারহাম কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের অ্যাকাডেমিতে তুলে নিয়ে গেল বেন স্টোকসকে। তার পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এলিভেটরে চড়েই তরতর করে এগিয়েছে তাঁর ক্রিকেটজীবন।
স্টোকস কি কাপ নিয়ে আসবেন তাঁদের ক্লাবে? জেফ বললেন, ‘‘কাপ নিয়ে আসতে পারবে কি না, জানি না। তবে আসবে অবশ্যই। ও আমাদের ক্লাবকে ভোলেনি। বন্যার সময় যখন সব ভেঙেচুরে গেল, খুব অসহায় লাগছিল। নিজে থেকে এসে সাহায্য করে যায় বেন। এখনও ক্লাবের যার সঙ্গে দেখা হবে, ডেকে কথা বলবে। নিয়মিত খোঁজ রাখে। ওকে নিয়ে হয়তো অনেক বিতর্ক হয়েছে কিন্তু আমরা জানি, বেন কত বড় এক হৃদয়েরও মানুষ।’’
রবিবারের পরে যিনি ইংল্যান্ডকে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতিয়ে সকলের চোখে নায়ক, সত্যিই তিনিই বারবার খলনায়ক হয়ে উঠেছেন। কখো পানশালার সামনে মারামারি করে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত। হাজতবাসের আতঙ্ক। ক্রিকেটজীবনই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। আবার কখনও নেশা করে বেসামাল গাড়ি ড্রাইভ করে ধরা পড়া। ইডেনে হতভাগ্য সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে কার্লোস ব্রাথওয়েটের হাতে চারটি ছক্কা খেয়ে পরাজয়ের চাবুকও হজম করতে হয়েছিল। এক ফাইনালের খলনায়ক। অন্য ফাইনালে নায়ক হয়ে স্বপ্নপূরণ। জেফ বলে ফেলছেন, ‘‘বেনের এই হার না-মানা মনোভাব আমরা কিশোর বয়স থেকে দেখেছি। কিছুতেই হাল ছাড়ার ছেলে ও নয়। লড়াইয়ে ও হারতে পারে, কিন্তু সেখানেই সব কিছু শেষ হতে দেবে না। ফিরে এসে আবার জিতবে। এক বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে অন্য বিশ্বকাপ ফাইনালে সেটাই ঘটাল।’’
সুপার ওভার। সুপার ম্যাচ। সুপারম্যান স্টোকস। লর্ডসে ইংল্যান্ডের অধরা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নপূরণই শুধু হল না, লেখা থাকল এক অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের রূপকথাও!