নজরে: সাউদাম্পটনে প্র্যাক্টিসে ফুরফুরে মেজাজে ঋষভ। (ডানদিকে) বিজয় শঙ্করের চোট উদ্বেগ বাড়িয়ে রাখল ভারতীয় শিবিরের। এপি
ইংল্যান্ডে বিরাট কোহালিদের রাতের ঘুম কাড়ার মতো দু’টো প্রতিপক্ষের উদয় ঘটেছে। বৃষ্টি এবং চোট-আঘাত।
প্রথমটা কোহালিরা যেখানে যাচ্ছেন, তাঁদের তাড়া করছে। ম্যাঞ্চেস্টারের পরে সাউদাম্পটনে এসেও নিস্তার নেই। এখানে বুধবারেও একটানা বৃষ্টি চলল। সারা দিন রোদের দেখাই পাওয়া যায়নি। সকাল ১০টা থেকে মেঘলা আকাশ আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই কোহালিরা প্র্যাক্টিস করলেন। তবে শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিতে হল জোরে বৃষ্টি এসে যাওয়ায়। সেই জোরে আসা বৃষ্টি এখানকার সময় সন্ধে ৬টা পর্যন্তও থামেনি। তাতে শনিবারের আফগানিস্তান ম্যাচ হবে কি না, নিয়ে সংশয় বেড়ে চলেছে। রশিদ খানদের সঙ্গে যদি পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয়, তা হলে পয়েন্ট টেবলে তা বিশাল ধাক্কা হবে ভারতের পক্ষে।
কোহালিদের মাথার উপর থেকে চোট-আঘাতের কালো মেঘও যেন সরছে না। শিখর ধওয়ন বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেন। ভুবনেশ্বর কুমার চোট পেয়ে বাইরে রয়েছেন। তাঁর পরিস্থিতি যাচাই করা হচ্ছে। দারুণ কিছু উন্নতি হয়েছে বলে মেডিক্যাল বুলেটিন নেই। যদিও দল সূত্রের খবর, ভুবিকে দু’টো ম্যাচে বাইরে বসতে হতে পারে। শিখরের মতো পুরোপুরি বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়নি তাঁর।
এর মধ্যেই আবার বুধবার প্র্যাক্টিসে দুম করে লাগল অলরাউন্ডার বিজয় শঙ্করের। নেটে ব্যাট করার সময় যশপ্রীত বুমরার ইয়র্কার এসে আছড়ে পড়ল তাঁর বাঁ-পায়ের পাতায়। ব্যাট ফেলে দিয়ে নেটের মধ্যে বসে পড়েন তিনি। দেখে মনে হল, বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট লেগেছে। শিখরের ছিল বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল। শঙ্করের লাগল বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুলে। আর ও দিকে তখন শিখরকে নিয়ে দুঃসংবাদ ঘোষণা করার তোড়জোড় চলছে। কারও কারও মনে হতে থাকল, কী সব অশুভ সঙ্কেত রে বাবা!
শঙ্করকে কাতরাতে দেখে অন্যেরা দ্রুত ছুটে এলেন। শুশ্রূষা পেয়ে দাঁড়ালেও যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন তামিলনাড়ুর অলরাউন্ডার। ও-দিকে বলটা যাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে, সেই বুমরা তখন অপরাধী-অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে। বাকি অনেক ক্রিকেটার তত ক্ষণে ব্যাটিং-বোলিং করে ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়েছেন। কোহালি, রোহিত শর্মারা নেই। কিন্তু কোচেরা সকলে আছেন। হেড কোচ রবি শাস্ত্রী থেকে শুরু করে বোলিং কোচ বি অরুণ, ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার সকলের নজর তখন শঙ্করের দিকে। কারও চোখের পলক পড়ছে না। একটা ধাক্কা সামলে উঠতে না-উঠতেই আবার কেউ চোটের বলি হতে যাচ্ছে নাকি?
বুমরা এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের এক জন। ভারতের সব চেয়ে জোরে বোলার তো বটেই। তার উপরে মেঘলা আকাশ এবং বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা আবহাওয়া। বাঁ-পায়ের পাতায় এমন আঘাত পাওয়া মোটেও হাল্কা ভাবে নেওয়ার মতো ব্যাপার নয়। প্রাথমিক শুশ্রূষার পরে শঙ্করের মুখ থেকে যন্ত্রণার ছায়া অনেকটা সরল। কিন্তু আঘাতের গুরুত্ব কতটা, তা বোঝার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। প্র্যাক্টিস শেষ হওয়ার অনেক পরে, লাঞ্চ-টাঞ্চ সেরে যখন ভারতীয় দল বাসে উঠছে হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য, তখন শঙ্করকে দেখা গেল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। পাশে এক সতীর্থ। মাঝেমধ্যে তাঁর কাঁধে হাত রেখে সাহায্যও নিতে হচ্ছে। জুতো পরতে পারেননি। চটি পরা। দেখে মনে হল, পায়ের পাতা কিছুটা ফুলেও রয়েছে। তবে হাসিখুশি মুখে মজা করতে করতেই বাসে উঠলেন। অর্থাৎ, মেজাজ ঠিক আছে। খুব নেতিবাচক শরীরী ভাষা নয়।
তবু মনে হবে, আকাশের মতোই কালো মেঘে ঢাকা একটা দিন গেল কোহালির দলের জন্য। শিখর ছিটকে গেলেন। ভুবিকে নিয়ে উন্নতির খবর নেই। বিজয় শঙ্করের চোট লাগল, এমন একটা সময়ে যখন হেড কোচ রবি শাস্ত্রী আলাদা করে তাঁর আর হার্দিক পাণ্ড্যর ক্লাস নিচ্ছেন। ১৯৮৩-তে কপিল দেবের বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শাস্ত্রী। তার পরে সুনীল গাওস্করের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৫-তে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের অভিযানে চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স। বিশ্ব মঞ্চে অলরাউন্ডারদের ভূমিকা কতটা বড় হতে পারে, শাস্ত্রী খুব ভাল করেই জানেন। তাই দলের দুই তরুণ অলরাউন্ডারকে তিনি সারা ক্ষণ নানা রকম পরামর্শ দিয়ে চলেছেন।
আলোচনা: ভারতের অনুশীলনের ফাঁকে অধিনায়ক বিরাট কোহালি, হার্দিক পাণ্ড্য ও হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। বুধবার। এপি
এ দিন যেমন প্র্যাক্টিসে দেখা গেল দীর্ঘ ক্ষণ ধরে তিনি হার্দিককে বোঝাচ্ছেন। হাত নেড়ে নেড়ে ব্যাটিংয়ের নানা খুঁটিনাটি দিক দেখিয়ে দিতে থাকলেন। হার্দিককে চার নম্বরে তোলার চাণক্য চালটাও তাঁরই। তেমনই ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তান ম্যাচের পরে অভয় দিয়েছেন শঙ্করকে। পাকিস্তান ম্যাচে শেষের দিকে নেমে খুব ভাল মারতে পারছিলেন না শঙ্কর। তা নিয়ে খুব চিন্তিত আর মুষড়ে ছিলেন। বুঝতে পেরে শাস্ত্রী আলাদা করে ডেকে তাঁকে বোঝান, বড় হিট করার জন্য কী কী করার দরকার। সাহস দিয়ে বলেছেন, এত লম্বা লম্বা হাত নিয়ে বড় স্ট্রোক করা তোর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। উৎসাহ দিয়েছেন এই বলে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলেছিস। নেমেই উইকেট পেয়েছিস। এখন তোর চনমনে থাকার সময়। বোলিংয়ে পাওয়া মানসিক জোরটা ব্যাটের ক্ষেত্রেও এ বার কাজে লাগা।
এ সব গুরু-বচনের মধ্যেই বিপত্তি। যত সময় যাচ্ছে, ঋষভ পন্থের জন্য তত বেশি করে দরজা খুলে যাচ্ছে। একের পর এক, কী নাটকীয় সব মোচড় আসছে তাঁর জীবনে। প্রথমে বিশ্বকাপের দলে সুযোগই পেলেন না। তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেল সারা দেশে। তার পরে ‘এ’ টিমের সঙ্গে সফরে বেরোতে যাবেন, সেই সময় ফোন এল বোর্ডের কাছ থেকে। ‘এ’ দলে নয়, যোগ দিতে হবে সিনিয়র দলে ইংল্যান্ডে। শিখরের জায়গায় স্কোয়াডে তো ঢুকে পড়ার দিনে পন্থকে ফের জোরদার ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করিয়ে রাখা হল নেটে। আর এখন তো যা পরিস্থিতি, আফগানিস্তান ম্যাচে যদি বিজয় শঙ্কর অনিশ্চিত হয়ে পড়েন, তখন তিনি সটান নেমেও পড়তে পারেন। কারণ, দলে অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান বলতে এখন থাকছেন দীনেশ কার্তিক এবং ঋষভ পন্থ। পরের জনকে ঘিরে আগ্রহ এতটাই বেশি যে, ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, কার্তিকও আছেন!
বিশ্বকাপে একটাও বল না-খেলে সব চেয়ে আকর্ষক, সব চেয়ে নাটকীয় চরিত্রের নাম এখন ঋষভ পন্থ! কারও সর্বনাশ, তাঁর পৌষ মাস!