হ্যাটট্রিকের হিউম-হুঙ্কার। ছবি: উৎপল সরকার।
আটলেটিকো দে কলকাতা-৪ (হিউম হ্যাটট্রিক, লেকিচ)
এফসি পুণে সিটি-১ (মুতু)
অভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যায়...।
ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে গমগম করে বাজছিল গানটা। তার সঙ্গে তালে তালে মাথা নাড়াচ্ছিলেন এটিকে মহানায়ক ইয়ান হিউম। যাঁকে দেখলে ইদানীং ২০ গজ দূর থেকেই কার্যত হৃদকম্প শুরু হচ্ছে বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের।
ম্যাচ শেষে হিউমের দিকে এটিকের হসপিটালিটি বক্স থেকে হাত নাড়াচ্ছিলেন টিমের বঙ্গসন্তান স্টপার অর্ণব মণ্ডলের স্ত্রী দেবশ্রী। তাঁর মতোই যুবভারতীর গোটা গ্যালারি ততক্ষণে জেনে গিয়েছে আইএসএল-টু-এর প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনালে জায়গা পাকা করে নিয়েছে হিউমের টিম।
পড়ুন: কেরল থেকে বাদ পড়েই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম হিউম কী বুঝিয়ে দেব
কিন্তু হাবাস? তিনি যে রয়েছেন হাবাসেই। আট দলের লিগ টেবলে ছয় নম্বরে নেমে যাওয়ার দিনে তুমুল সমালোচনার মধ্যেও যে রকম মেজাজে, ঠিক সে রকমই শেষ চারের পাসপোর্ট হাতে এসে যাওয়ার পরেও। ড্রেসিংরুমে হিউমকে নিয়ে উচ্ছ্বাস শুরু হব হব করছিল। স্প্যানিশ কোচ দিলেন জল ঢেলে। ড্রেসিংররুমে ঢুকে তাঁর প্রথম কথাই ‘‘নো সেলিব্রেশন। ওটা যদি হয়, তা হলে হবে গোয়াতে।’’
মানে ২০ ডিসেম্বর ফাইনালে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এর পর ‘সাদা শার্ট’-এর সটান মন্তব্য, ‘‘সেমিফাইনাল নিয়ে কোনও কথা নয়। ওটা আলাদা ম্যাচ। এখনও লিগে মুম্বই ম্যাচ বাকি রয়েছে।’’ তবুও উড়ে এল প্রশ্নটা। শেষ চারে কাকে চাইছেন? উচ্ছ্বাসহীন গলায় কলকাতা কোচের জবাব, ‘‘জানতে অপেক্ষা করতে হবে। বাছতে তো পারব না।’’ আর ম্যাচের নায়ক হিউম? হাবাসের এক বাক্যের মূল্যায়ন, ‘‘ওর এনার্জিটাই তফাত গড়ে দেয়।’’
পড়ুন: মজিদের টাচ না থাকুক সেই ঠান্ডা মাথাটা আছে হিউমের
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও হিউমের ‘এনার্জি’তে মোহিত। গত রবিবার গোয়া ম্যাচের দিনই হিউম আর তার বাবা-বোনের সঙ্গে আলাপ এটিকের অন্যতম মালিকের। এ দিন সৌরভ বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা ফুটবলের সঙ্গে ক্রিকেটেরও দারুণ খবর রাখে। সচিনের টিম ওকে ছেড়ে দিল কেন?’’ বলেই হাসতে শুরু করলেন। হাসি থামিয়ে ফের বললেন, ‘‘ভাল হয়েছে। আমরা গোলমেশিন পেয়ে গিয়েছি।’’
হিউমের বোন লরা জ্যোতিষী নন। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিংয়ে তাঁর মন। তা সত্ত্বেও রবিবারই বলে গিয়েছিলেন, ‘‘ইয়ান পুণে ম্যাচেও গোল করবে।’’ লরার সেই ইয়ান এ দিন আইএসএলে তাঁর দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকই শুধু করলেন না। গোল লাইন সেভ করেও টিমকে বাঁচালেনও। হিউমের মেগা পারফরম্যান্স জয়ের হ্যাটট্রিক এনে দিল হাবাসের ড্রেসিংরুমেও। চেন্নাই, গোয়ার পর প্রথম বার পুণে-বধ। শেষ আট ম্যাচে দু’টো হ্যাটট্রিক-সহ নয় গোল! বল পায়ে এবং বল ছাড়াও এ দিন হিউম কাঁদিয়ে ছাড়লেন ডেভিড প্ল্যাটের টিমকে। বক্সের সামনে ছটফটানি আর গোলের গন্ধ পেলে দ্রুত বলের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা তাঁর ইউএসপি। এ দিন হ্যাটট্রিকের গোলটা সেই থিওরিতেই। টিম বাসে ওঠার সময় মিডিয়ার সামনে কানাডিয়ানের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা, ‘‘টেস্ট ক্রিকেটে গোলাপি বল চালুর দিনই আমার দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। দিনটা মনে থাকবে তো!’’
কী ভাবে শেষ চারে
• প্রথম তিন ম্যাচের দুটোতে জয়। একটা ড্র।
• এর পর টানা তিনটে হারে পয়েন্ট টেবলে দ্রুত পতন।
• পরের দু’ম্যাচে প্রথমটা জিতলেও দ্বিতীয়টায় ফের হার। তবে সেটাই শেষ।
• শেষ পাঁচ ম্যাচে একটা ড্র বাদ দিলে দাপটে টানা তিনটে জয় নিশ্চিত করে সেমিফাইনালে।
জিকোর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ডেভিড প্ল্যাটের। কিন্তু কলকাতার আগের ম্যাচে বধ হওয়া গোয়া দলের কোচ যে আসল কথাটাই বলেননি পুণের কোচকে! সূত্রের খবর, গত সোমবার জিকোর সঙ্গে নাকি কথা হয় প্ল্যাটের। সেখানেই পুণে কোচ কলকাতার মাঠ সম্পর্কে জানতে চাইলে জিকো বলেন, ‘‘কলকাতার মাঠটা খেলার সময় মুভ করে।’’ কথাটা শুনে প্রথমে নাকি চমকে যান ম্যাঞ্চেস্টার সিটির প্রাক্তন সহকারী কোচ প্ল্যাট। অবাক স্বরে বলেন, ‘‘মাঠ মুভ করে! সেটা কী!’’
আসলে জিকো বলতে চেয়েছিলেন শট মারার সময় যুবভারতীর মাঠের ঘাস উঠে আসার কথা। কিন্তু ব্রাজিলের বিখ্যাত দশ নম্বর সে দিন বলেননি, হাবাসের টিমের থার্ড ম্যান মুভের কথা। বলেননি দ্যুতি আর আরাতার উইং প্লের কাহিনি। গ্যাভিলানের ঠিকানা লেখা বল বাড়ানো। আর বোরহা মাঝমাঠে সেকেন্ড বলটা দখল করে কেমন জিব্রাল্টারের পাহাড় হয়ে থাকেন।
পড়ুন: গুরু হাবাসের ম্যাজিক নম্বর আজ তিন
প্ল্যাট ‘হাই ডিফেন্স’ থিওরি প্রয়োগ করে তাঁর ব্যাক ফোরকে মাঝমাঠে তুলে এনে খেলছিলেন। উদ্দেশ্য হিউমদের অফ সাইডের জালে জড়িয়ে নেবেন। কিন্তু মিডিও থেকে মণীশ মৈথানিকে (প্রীতম কোটাল কেন বসে তার উত্তর দেননি এই ইংরেজ বিশ্বকাপার সাংবাদিক সম্মেলনে) রাইট ব্যাক বানালে যা হয়, তাই হয়েছে। ওভার হেড বল আসলেই গতিতে প্ল্যাটের পাতা জাল ছিঁড়ে ফেলছিলেন আরাতা, দ্যুতি। নিট ফল— হিউমের তিন গোল, লেকিচের এক। ববি রবসনের ছাত্র প্ল্যাট ম্যাচ শেষে মুখ লাল করে বলে গেলেন, ‘‘একটা গোল ম্যাচ বদলে দেয়। এখানেও তাই হল। আমরা চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি।’’
পুণের আদ্রিয়ান মুতুর ছটফটানি শুরুতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তিরিদের। পুণের তিনটে শট পোস্টে লেগে না ফিরলে হাসি থাকার কথা তাঁর মুখে। শেষ বেলায় একটা দুরন্ত গোল করলেন বটে মুতু। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। পরাজিত বীরের খেতাব ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই রোমানিয়ার হায়েস্ট স্কোরারের।
স্ত্রী মধুর সঙ্গে এ দিন হসপিটালিটি বক্সে বসে খেলা দেখছিলেন কলকাতা টিমের অন্যতম মালিক হর্ষ নেওটিয়া। তিনি বলছিলেন, ‘‘সমালোচনার মধ্যেও টিমটা উঠে দাঁড়াল তিন জনের জন্য। হাবাস, অমরিন্দর, আর হিউম।’’
পড়ুন: আমার এক নম্বর হাবাস
হাবাস এ দিন চেয়েছিলেন তিন। সেই তিন পয়েন্টের সঙ্গে এল টানা তৃতীয় জয়। মালিকের সেরা তিন বাছাইও!
বিটলরা তো কবেই গেয়েছে ‘টুমরো নেভার নোজ’। আগামী কাল কেউ জানে না..।
ছয় নম্বর থেকে সবার আগে সেমিফাইনাল!
আটলেটিকো দে কলকাতা: অমরিন্দর, রিনো, অর্ণব, তিরি, অগাস্টিন, বোরহা, নাতো (আলোন্সো), দ্যুতি (লেকিচ), গ্যাভিলান(ভালদো), আরাতা, হিউম।